বাঁকখালীসহ চার নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে

কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সন্মেলনকক্ষে জাতীয় নদী রক্ষা কমিটির মতবিনিময় সভায় বক্তব্য দেন কমিশনের চেয়ারম্যান সারোয়ার মাহমুদ। আজ দুপুরেছবি: প্রথম আলো

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান সারোয়ার মাহমুদ বলেছেন, দখল-দূষণে কক্সবাজার শহরের প্রধান নদী বাঁকখালী এখন মৃতপ্রায়। জেলার মাতামুহুরী, কুহেলিকা নদী ও রেজু নদের চেহারাও মলিন। দখলের কারণে নদীর পানি চলাচলের গতিপথ সীমিত হয়ে এসেছে, নৌযান চলাচলে সমস্যা হচ্ছে। দ্রুততম সময়ে এসব নদীর সীমানা নির্ধারণ করে অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করতে হবে। নইলে নদী বলতে যেটুকু আছে, তা–ও হারিয়ে যাবে।

আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সম্মেলনকক্ষে জেলা নদী রক্ষা কমিটির সদস্যদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান। তিনি আরও বলেন, দখল-বেদখলের কারণে নদীর উৎসগুলো ধ্বংস হচ্ছে, উষ্ণতা বাড়ছে। ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। সিএস জরিপ অনুযায়ী নদীর সীমানা নির্ধারণের নিয়ম থাকলেও কক্সবাজারে সিএস জরিপ হয়নি। তাই বলে বসে থাকা চলবে না। বিএস দাগ অনুসরণ করেই নদীর দখলদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা এবং অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে।

জেলা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরানের সভাপতিত্বে এই মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ধর্মবিষয়ক সম্পাদক সিরাজুল মোস্তফা বলেন, বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাট দিয়ে একসময় স্টিমারে করে মানুষ চট্টগ্রামে যাতায়াত করতেন। সেই কস্তুরাঘাট এখন অবৈধ স্থাপনায় ভরপুর। চকরিয়ার মাতামুহুরী নদী, মহেশখালীর মাতারবাড়ীর কুহেলিকা নদী, উখিয়ার রেজু নদও দখলদারের খপ্পরে পড়েছে। কুহেলিকা নদী দখল করে চিংড়ি ঘের ও লবণ উৎপাদনের মাঠ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, সোনাদিয়ায় প্যারাবন অধিগ্রহণ করে বেজা টু৵রিজম পার্ক করতে চেয়েছে। এখনো পার্কের কিছুই হয়নি, অথচ প্যারাবন উজাড় হয়ে যাচ্ছে। অধিগ্রহণ করা প্যারাবন পাহারা কিংবা রক্ষণাবেক্ষণে সেখানে বেজার কেউ নেই। দখলদারের বিরুদ্ধেও মামলা হচ্ছে না। ভরাট নদী খননের উদ্যোগ নেই, কিন্তু নদী থেকে বালু তুলে শতকোটি টাকার ব্যবসা হচ্ছে।

দখলদারের তালিকা হালনাগাদ করে গণমাধ্যমে প্রকাশের দাবি জানান কক্সবাজার প্রেসক্লাবের সভাপতি আবু তাহের। তিনি বলেন, বাঁকখালী নদীর দখলদার হিসেবে ২০১৯ সালে ১০৯ জনের একটি তালিকা হয়েছিল। এখন দখলদার বাড়লেও তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে না। নদীর দুই তীর দখল করে শত শত অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করা হলেও উচ্ছেদ হয় না। উচ্ছেদ করার ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসনের তহবিলও নেই। আবু তাহের আরও বলেন, বাঁকখালী নদীর বিভিন্ন এলাকা দখল করে মাছ ধরার ট্রলার মেরামতের জন্য একাধিক ডকইয়ার্ড গড়ে তোলা হয়েছে। ডকইয়ার্ডের পোড়া তেল এবং বিষাক্ত ধোঁয়া পানিতে মিশে নদীকে দূষিত করছে। এতে মাছের মৃত্যু হচ্ছে, ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য।

দৈনিক কক্সবাজার পত্রিকার পরিচালনা সম্পাদক মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম বলেন, জাল দলিল সৃষ্টি করে বাঁকখালী নদীর কয়েক শ একর প্যারাবন দখল করে তাতে শতাধিক অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন একাধিকবার অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করলেও পরে আবার তা তৈরি হচ্ছে। যৌথ অভিযান চালিয়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে সীমানা খুঁটি স্থাপন জরুরি হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার জেলা কমিটির সভাপতি করিম উল্লাহ বলেন, মহেশখালীর সোনাদিয়াসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে কয়েক হাজার একর প্যারাবন ধ্বংস করে শতাধিক চিংড়িঘের নির্মাণ করা হয়েছে। আরও প্যারাবন ধ্বংসের চক্রান্ত চলছে। আন্দোলন করেও প্যারাবন নিধন বন্ধ করা যাচ্ছে না। নদী, খাল, জলাশয় ভরাট করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ ক্রমেই বাড়ছে। তাতে পরিবেশ ও প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।

সভায় কক্সবাজারের নদীগুলোতে যৌথ জরিপ চালিয়ে সীমানা নির্ধারণের কাজ শেষে অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করা হবে বলে জানান জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান। তিনি বলেন, পৌরসভার ময়লা-আবর্জনা ফেলার ডাম্পিং স্টেশন না থাকায় বাঁকখালী নদীতে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। মেডিকেল বর্জ্য ফেলারও ব্যবস্থা ৯৯ শতাংশ হাসপাতালে নেই। শহরের পাঁচ শতাধিক হোটেলের ১০টি ছাড়া বাকিগুলোতে সুষ্ঠু পয়োব্যবস্থাপনা নেই। শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কেন্দ্রীয় এসটিপি তৈরির কাজ চলছে।

মতবিনিময় সভায় জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) জাহিদ ইকবাল, কক্সবাজার পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী পরাক্রম চাকমা, বিআইডব্লিউটিএ চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপপরিচালক নয়ন শীল, পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের পরিদর্শক ফাইজুল কবির, কক্সবাজার আদালতের সাবেক পিপি ফরিদুল আলম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।