‘সামনের দিনগুলান যে ক্যামনে চলবে, কইতে পারি না’

সাগর থেকে ফিরে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার শিববাড়িয়া নদে মাছ ধরার ট্রলার ভিড়িয়েছেন জেলেরা। গতকাল তোলা

‘মাইনসের ট্রলারে কাম করি। হের মধ্যে গত বছর ৬০ হাজার টাহা ঋণ করতে হইছে। অ্যাহন পর্যন্ত হেই ঋণের টাহা পরিশোধ করতে পারি নাই। এর মধ্যে আবার ৬৫ দিনের অবরোধ শুরু হইছে। সামনের দিনগুলান যে ক্যামনে চলবে, কইতে পারি না।’ সাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে কথাগুলো বলছিলেন পটুয়াখালীর কলাপাড়ার জেলে আফসার উদ্দিন।

মাছের উৎপাদন ও প্রজনন বাড়াতে গতকাল রোববার মধ্যরাত থেকে বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় শুরু হয়েছে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ শিকারের ওপর ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা। সরকারি এ নিষেধাজ্ঞা চলবে ২৩ জুলাই রাত ১২টা পর্যন্ত। এ সময়ে দেশের সামুদ্রিক জলসীমানায় সব ধরনের মৎস্য শিকার, পরিবহন ও সংরক্ষণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এ সময়ে প্রত্যেক জেলের জন্য ৮৬ কেজি করে চাল বরাদ্দ করেছে সরকার।

নিষেধাজ্ঞা মেনে গতকালই সাগর থেকে থেকে উপকূলে ফিরে এসেছেন অধিকাংশ জেলে। উপজেলার আলিপুর-মহিপুরের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত শিববাড়িয়া নদের পোতাশ্রয়ে আশ্রয় নিয়েছেন তাঁদের অনেকেই। সেখানে অলস সময় কাটাচ্ছেন তাঁরা। তবে ঋণ পরিশোধ করা নিয়ে তাঁরা দুশ্চিন্তা আছেন।

এসব জেলেদের অনেকেই বলছেন, সমুদ্রে মাছ শিকারের নিষেধাজ্ঞা শুরু হওয়াতে তাঁরা এখন পরিবার নিয়ে বিপাকে পড়বেন। চলতি বছর ভরা মৌসুমেও সাগরে মাছের আকাল থাকায় সেভাবে মাছ শিকার করতে পারেনি তাঁরা। তার ওপর ঋণ এবং ধারদেনার বোঝা তো আছেই।

জেলে মমিন ইসলাম বলেন, ‘এই বছর সাগরে তেমন মাছ ধরা পড়ে নাই। এ কারণে কষ্ট কইরা সংসার চালাইতে হইতেছে। হের ওপর আছে ঋণের দায়, আর মহাজনের দাদনের টাহা। কেমনে কী যে করমু, এহন হতাশ হইয়া গেছি।’

আরও পড়ুন

শুধু জেলেরা নন, এ পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার জন্যই নিষেধাজ্ঞার সময়টুকু বেশ কষ্টের বলে জানান ট্রলার মালিক কামাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘জমি জমা বিক্রি কইরা দুইটা ট্রলার তৈরি করেছিলাম। এতে লাভ তো দূরের কথা, আরও দেনায় পড়ছি। শেষে ওই ট্রলার দুইটা বিক্রি কইরা মানুষের ধারদেনা পরিশোধ করছি। এখন মাছের ব্যবসা ছাইড়া নিজের অল্প কিছু জমিতে কৃষিকাজ করি।’

পান্না হাওলাদার নামের এক আড়তদার বলেন, ‘বরিশাল বিভাগের মধ্যে অন্যতম বড় দুটি মৎস্যবন্দর আলীপুর ও মহিপুর। এখান থেকে কোটি কোটি টাকার মাছ চালান হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। তবে গত কয়েক বছর যাবৎ বৈরী আবহাওয়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি হওয়ায় বন্দর দুটির জেলেরা তাঁদের অস্তিত্ব নিয়ে সংকটে পড়েছে।’

অনেক জেলে অভিযোগ করে বলেন, অবরোধকালীন সময়ে প্রতিবছর ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমানায় প্রবেশ করে মাছ ধরে। এটা বন্ধ করা দরকার। এতে মাছের প্রাচুর্য আরও বাড়তে পারে।

এদিকে নিষেধাজ্ঞার সঠিক সময় নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন মহিপুর মৎস্য আড়তদার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রাজু আহম্মেদ। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন প্রজাতির মাছের প্রজনন সময় এখন থেকে দেড় মাস বাকি। এই ৬৫ দিনের অবরোধের সময় সঠিকভাবে চিহ্নিত করে নির্ধারণ করা হোক। এতে মৎস্য সম্পদ যেমন সমৃদ্ধ হবে, সেই সঙ্গে জেলেরাও লাভবান হবেন।’

এসব বিষয়ে জেলার মৎস্য কর্মকর্তা (ডিএফও) কামরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জেলেরা যাতে অতি দ্রুত আপত্কালীন সহায়তা পায়, সে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রজননকালীন সময় নিয়ে তাঁরা যে কথা বলেছেন, তা সঠিক নয়। ৬৫ দিনের এ অবরোধকালীন সময় অত্যন্ত বিজ্ঞানভিত্তিক ও উপযুক্ত হয়েছে। এ সময় জেলেরা নিষেধাজ্ঞা মেনে চললে মাছের প্রাচুর্য বহুগুণ বাড়বে।