চরমপন্থী সংগঠন থেকে আওয়ামী লীগে শিমুল ভূঁইয়ার পরিবার

শিমুল ভূঁইয়াফাইল ছবি: সংগৃহীত

খুলনায় গত ১৫ বছরের বেশি সময় শীর্ষ চরমপন্থী নেতা শিমুল ভূঁইয়াকে দেখেননি কেউই। এই সময়ের মধ্যে ফুলতলার বাড়িতেও আসেননি। তারপরও খুলনা অঞ্চলে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ, জনপ্রতিনিধি নির্ধারণ, ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ, খুন, চাঁদাবাজি সবই হতো তাঁর ইশারায়। সবই নিয়ন্ত্রিত হতো তাঁর নামে। কেউ তাঁর বা তাঁদের পরিবারের সঙ্গে বিরোধে জড়াতেন না। এমনটাই জানা গেছে খুলনার কয়েকজন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীর কাছ থেকে। তবে পুলিশের কাছে তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্য নেই।

ফুলতলার দামোদর ইউনিয়নের দামোদর গ্রামে শিমুল ভূঁইয়ার বাড়ি। ফুলতলা উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, শিমুল ভূঁইয়া সরাসরি কারও সঙ্গে ফোনে কথা বলতেন না। মাঝেমধ্যে হোয়াটসঅ্যাপে ফোন দিতেন। এ ছাড়া তাঁর ভাই শিপলু এসে শিমুল ভূঁইয়ার নাম করে বালুমহাল, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করতেন। শিমুলের নাম শোনার পর ওই কাজে বিরোধিতা করবেন, এমন কারও সাহস ছিল না।

আমরা শিমুল ভূঁইয়াকে সন্ত্রাসী হিসেবে জানতাম, কিন্তু তাঁর ভাইয়ের নামে কোনো অভিযোগ ছিল কি না, তা জানতাম না।
জেলা যুবলীগের তৎকালীন সভাপতি মো. কামরুজ্জামান জামাল

আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গোয়েন্দা সংস্থার খাতায় খুলনা জেলার শীর্ষ সন্ত্রাসীদের একজন শিমুলের ভাই শিপলু। ২০১৪ সালের ১১ নভেম্বর ফুলতলায় যুবলীগের সমাবেশে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দের হাতে ফুল দিয়ে যুবলীগে যোগ দেন তিনি। দলে ভেড়াতে সহযোগিতা করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শেখ আকরাম হোসেন। এরপর ২০১৬ ও ২০২১ সালে পরপর দুইবার নৌকা প্রতীক নিয়ে দামোদর ইউপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

২০১৬ সালে খুলনার শীর্ষ সন্ত্রাসী ও চরমপন্থীদের তালিকা করে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। ওই তালিকায় ৩ নম্বরে ছিল শিপলু ভূঁইয়ার নাম। আর ৪ নম্বরে ছিল শিমুল ভূঁইয়ার নাম। শিপলু ভূঁইয়া যখন যুবলীগে যোগ দেন, তখন তাঁর নামে হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ ১২টির মতো মামলা ছিল। তারপরও কীভাবে যুবলীগে যোগ দেন, জানতে চাইলে জেলা যুবলীগের তৎকালীন সভাপতি মো. কামরুজ্জামান জামাল বলেন, ‘আমরা শিমুল ভূঁইয়াকে সন্ত্রাসী হিসেবে জানতাম, কিন্তু তাঁর ভাইয়ের নামে কোনো অভিযোগ ছিল কি না, তা জানতাম না।’

ফুলতলা উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মৃণাল হাজরা বর্তমান সভাপতি আকরাম হোসেনের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘ফুলতলা উপজেলা আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত। অন্য পক্ষ নিজেকে শক্তিশালী করতে শিপলুকে দলে ভিড়িয়েছিল।’

দলকে শক্তিশালী করতে শিপলুকে যুবলীগে নিতে ভূমিকা রেখেছিলেন বলে মন্তব্য করে শেখ আকরাম হোসেন বলেন, ‘আমি ও নারায়ণ চন্দ্র চন্দ একই মঞ্চে থেকে তাঁদের দলে নিয়েছিলাম। যখন তাঁদের দলে নেওয়া হয়েছিল, সেই সময়ের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। কারণ, তখন ফুলতলাতে বিএনপির সঙ্গে লড়াই করার মতো শক্তি ছিল না।’

খুলনা-৫ আসনের (ডুমুরিয়া-ফুলতলা) পাঁচবারের সংসদ সদস্য নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বর্তমান সরকারের ভূমিমন্ত্রী। শিপলু ভূঁইয়াকে আওয়ামী লীগে ভেড়ানোয় বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণ চন্দ্র চন্দ প্রথম আলোকে বলেন, ‘একজন সংসদ সদস্য হিসেবে ওই সমাবেশে যোগ দিয়েছিলাম আমি। সেখানে কয়েকজন যুবলীগে যোগদান করবে বলে জানতাম। কিন্তু তার মধ্যে শিপলু ছিল, তা জানতাম না। শিপলু সম্পর্কে বিশেষ কোনো তথ্যও ছিল না। আকরাম হোসেন একেবারে প্রথমেই শিপলুকে মঞ্চে নিয়ে এসে আমার হাতে ফুল দিয়ে দেন।’

শিপলুকে ইউপি নির্বাচনে জেতানোর ক্ষেত্রে শিমুল ভূঁইয়া এলাকার বাইরে থেকেও অদৃশ্যভাবে কাজ করেন। এরপর স্ত্রীকেও জেলা পরিষদের (৫ নম্বর ওয়ার্ড) সদস্য বানান। এই ওয়ার্ড থেকে ২০২২ সালের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেলা পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন শিমুল ভূঁইয়ার স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন। এ ব্যাপারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছিলেন শিমুল। তিনি আওয়ামী লীগের নেতাদের বলেছিলেন অন্য কাউকে প্রার্থী না করতে। এরপর ভয়ে আর কেউ প্রার্থী হননি।

জেলা পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা শুধু শিমুল ভূঁইয়ার নামই শুনেছেন। বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে তাঁর নাম শোনা গেছে। তবে গত পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে তাঁর বিরুদ্ধে কেউ কোনো অভিযোগ করেননি। এমনকি তিনি এলাকায়ও আসতেন না বলে তাঁরা শুনেছেন।

গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, শিমুল ভূঁইয়া চরমপন্থী সংগঠন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল-লাল পতাকা) খুলনা অঞ্চলের প্রধান। কলকাতার নিউ টাউনের একটি ফ্ল্যাটে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমকে (আনার) খুনে ভাড়া করা হয় তাঁকে। আনোয়ারুল খুনের ঘটনায় ঢাকায় ধরা পড়ার পর পুলিশের কাছে শিমুল ভূঁইয়া নিজেকে সৈয়দ আমানুল্লাহ নামে পরিচয় দিয়েছেন। এই খুনের ঘটনায় শিমুল ভূঁইয়ার বড় ভাই হানিফ মুহাম্মদ ভূঁইয়ার ছেলে তানভীর ভূঁইয়াকেও গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

ভগ্নিপতির হাত ধরেই চরমপন্থায় শিমুল

গোয়েন্দা সংস্থা ও স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে জানা গেছে, ১৯৮৬ সালের দিকে শিমুল ভূঁইয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে স্নাতকের ছাত্র ছিলেন। সেই সময় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল-লাল পতাকা) শীর্ষ নেতা মিজানুর রহমান টুটুলের মাধ্যমে ওই পার্টির কাজে যুক্ত হন। টুটুল ছিলেন ছিলেন শিমুলের ভগ্নিপতি। ১৯৮৫ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে এক বছর সরকারি চাকরি করেছিলেন টুটুল। এরপর চাকরি ছেড়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। তিনি ছিলেন পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল-লাল পতাকা) সম্পাদক (পার্টি প্রধান), যিনি ২০০৮ সালের ২৭ জুলাই র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।

১৯৯১ সালে শিমুল প্রথমবার খুলনায় পার্টির সদস্যপদ পান। ওই বছরের শেষের দিকে শিমুলসহ পাঁচজন খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার শৈলগাতী বাজারে এমরান গাজীকে গুলি করে হত্যা করেন। পালানোর সময় স্থানীয় লোকজন তাঁদের তিনটি অস্ত্রসহ আটক করে ডুমুরিয়া থানা-পুলিশের কাছে সোপর্দ করেন। পরে এমরান গাজী হত্যা মামলায় শিমুলের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ওই মামলায় শিমুল ১৯৯১ সালের ২৩ ডিসেম্বর থেকে ১৯৯৭ সালের ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত কারাগারে ছিলেন। উচ্চ আদালতে আপিলের মাধ্যমে হত্যাসহ ৩টি মামলায় ১৯৯৭ সালের ১৪ এপ্রিল জামিনে মুক্তি পান। কিন্তু পরে আর আদালতে হাজিরা না দিয়ে পলাতক ছিলেন।

১৯৯৮ সালের ১৮ আগস্ট দুপুরে ফুলতলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে দামোদর ইউপি চেয়ারম্যান সরদার আবুল কাশেমকে গুলি করে হত্যা করেন শিমুল ও তাঁর সহযোগীরা। ওই মামলায় শিমুলের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। তবে তিনি উচ্চ আদালত থেকে জামিনে রয়েছেন। ১৯৯৯ সালের ২০ মে রাতে শিমুল ও তাঁর সহযোগীরা খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পেছনে গণেশ নামের এক ব্যক্তিকে গলা কেটে হত্যা করেন। ২০০০ সালের ২৫ মে যশোরে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন শিমুল। ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই জামিনে যশোর কারাগার থেকে বের হন। এর পর থেকেই ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন তিনি।

শিমুল কারাগারে থাকা অবস্থায় ২০১০ সালের ১৬ আগস্ট কাশেম সরদারের ছেলে ও দামোদর ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাঈদ বাদলকে গুলি করে হত্যা করা হয়। শিমুলের নির্দেশে তাঁর সহযোগীরা ওই হত্যাকাণ্ড ঘটায় এমন অভিযোগ রয়েছে। ২০১৭ সালের ২৫ মে রাতে নিজ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে গুলি করে হত্যা করা হয় ফুলতলা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সরদার আলাউদ্দিনকে (মিঠু)। এ মামলায় ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর আদালতে জমা দেওয়া অভিযোগপত্রে প্রধান আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয় শিমুল ভূঁইয়াকে।

জানতে চাইলে খুলনা জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাংবাদিকদের কাছ থেকেই আমরা শিমুল ভূঁইয়ার নাম শুনেছি। তাঁর সম্পর্কে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। অন্য কেউ কখনো তাঁর সম্পর্কে কিছু জানায়নি।’