ভাঙনে বিপন্ন টেংরাগিরি বন

ভূমিক্ষয়ে এ বনাঞ্চলের আয়তন প্রতিনিয়ত কমছে। প্লাবনভূমি বেড়ে যাওয়ায় শ্বাসমূলে বালু জমে মারা পড়ছে হাজারো গাছ।

টেংরাগিরি বনাঞ্চলে সারি সারি মৃত গাছ। সম্প্রতি বরগুনার তালতলী উপজেলার আশারচরে
ছবি: প্রথম আলো

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বন টেংরাগিরি প্রাকৃতিক বিপদে ক্রমেই অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। তীব্র ঢেউয়ে ভূমিক্ষয়ের কবলে পড়ে দেশের দক্ষিণ উপকূলের সংরক্ষিত এ বনাঞ্চলের আয়তন প্রতিনিয়ত কমছে। অপর দিকে প্লাবনভূমি বেড়ে যাওয়ায় শ্বাসমূলে বালু জমে মারা পড়ছে হাজারো গাছ। এই শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চলের বিপন্ন দশার মধ্যেই আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক বন দিবস।

বরগুনার তালতলী থেকে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা পর্যন্ত বিস্তৃত এই বনাঞ্চলটির আয়তন ১৩ হাজার ৬৪৪ একর। এটি ফাতরার বন নামে স্থানীয়ভাবে পরিচিত। ১৯৬৭ সালে বন বিভাগ একে ‘টেংরাগিরি বনাঞ্চল’ নামকরণ করে। সুন্দরবনের পর এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল। পরিবেশ-প্রতিবেশের পরিবর্তনে আয়তন কমছে সংরক্ষিত বন টেংরাগিরির। এই বনাঞ্চলে প্রতিবছর মরছে অসংখ্য গাছ। প্রকৃতির এই বিপদ থেকে বনটিকে সুরক্ষায় কোনো উদ্যোগ নেই।

‘ওয়েদার আন্ডারগ্রাউন্ড’ নামের একটি ওয়েবসাইটে বিশ্বের ৩৬টি ভয়ংকর মৌসুমি ঘূর্ণিঝড়ের তালিকা রয়েছে, এই তালিকায় থাকা ২৬টি ঘূর্ণিঝড়ই বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট। ২০০৭ সালের পর দেশে আঘাত হানে বড় নয়টি ঘূর্ণিঝড়। পরিবেশবিদেরা বলেন, টেংরাগিরি বন ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব থেকে রক্ষা করে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোকে। সুন্দরবনের পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের সময় গতিরোধক (উইন্ড ব্রেকার) হিসেবে কাজ করেছে। এ কারণেই ঝড়ের তাণ্ডব তুলনামূলক কম দেখা গেছে।

পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী লিংকন বায়েন বলেন, টেংরাগিরি বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলকে সুরক্ষা দিয়ে আসছে। পরিবেশ-প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় এই বনের ভূমিকা অপরিসীম। টেংরাগিরির অস্তিত্ব বিলীন হলে জলবায়ু ও পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বনের অস্তিত্ব রক্ষায় কোনো উদ্যোগ না থাকাটা দুঃখজনক।

১৯২৭ সালের জরিপ অনুযায়ী ১৯৬০ সালের ১২ জুলাই তৎকালীন সরকার এটিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করে। তালতলী উপজেলার বড় নিশানবাড়িয়া ও সখিনা দুটি বিট নিয়ে এই বনাঞ্চল। লবণাক্ত ও মিষ্টি মাটির অপূর্ব মিশ্রণের কারণে এই বনে গেওয়া, জাম, ধুন্দল, কেওড়া, সুন্দরী, বাইন, করমচা, বলই কেওয়া, গরানগাছের সমারোহ। এখানে বসত গড়েছে কাঠবিড়ালি, বানর, প্রায় ৪০ প্রজাতির সাপ, শজারু, শূকর, উদ (ভোঁদড়), কচ্ছপ, শিয়াল, ডোরাকাটা বাঘ, বনমোরগ, কাঁকড়াসহ হাজারো প্রজাতির প্রাণী। অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য এই বনে গড়ে উঠেছে সোনাকাটা ইকোপার্ক পর্যটনকেন্দ্র।

বন বিভাগ বলছে, এই বনে গাছের মৃত্যুর কারণ শ্বাসমূলে বালু জমে যাওয়া ও ভূমিক্ষয়। প্রবল ঢেউয়ে উপকূলে পাড় ভাঙছে। গাছের গোড়ার মাটি ও বালু সরে গিয়ে শিকড় শুকিয়ে যাচ্ছে। বনে প্লাবনভূমির পরিমাণ ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে। এতে এসব শ্বাসমূলীয় গাছ ঠিকভাবে অক্সিজেন নিতে না পারায় পাতা ও কাণ্ড হলদে হয়, পরে মরে বিবর্ণ হয়ে যায়। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী পরিবেশবিদ রফিকুল আলম বলেন, উপকূলীয় বনে ব্যাপক পলি পড়ে যেসব গাছের শ্বাসমূল ঢেকে যাবে, সেসব গাছ মারা যাবে।

সরেজমিন

গত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সরেজমিনে দেখা যায়, টেংরাগিরি বনের আশারচর, দক্ষিণ দিকের শেষ সীমানায় সোনাকাটা সৈকতের বালিয়াড়িতে অসংখ্য মৃত রেইনট্রি, কেওড়া ও ছৈলাগাছ মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। বঙ্গোপসাগরের প্রবল ঢেউয়ের তোড়ে আরও অসংখ্য গাছের গোড়ার মাটি সরে গিয়ে শিকড়বাকড় বের হয়ে গেছে। বালুতে এসব গাছের শ্বাসমূল ঢাকা পড়েছে। গাছগুলোর পাতা ও কাণ্ড হলদেটে হয়ে গেছে। বনের মধ্যে জোয়ারের পানি ঢুকে ভূমির ক্ষয় ত্বরান্বিত করছে। সখিনা, নিশানবাড়িয়া, নলবুনিয়া সংরক্ষিত বনে গিয়েও একই দৃশ্য চোখে পড়ে।

স্থানীয় বাসিন্দা দুলাল মিয়া বলেন, ভাঙতে ভাঙতে আশার চরের আয়তন অর্ধেকও নেই। একই অবস্থা শুভসন্ধ্যা সৈকতের। এ ছাড়া বনের ভেতর অসংখ্য গাছ প্রতিবছর মারা যাচ্ছে। তেমনি আছে কাঠ চোরদের অবাধ তৎপরতা।

বন বিভাগ বলছে, প্রায় ১৫ বছর ধরে এই ভাঙন অব্যাহত আছে। বনের ২১ কিলোমিটারজুড়ে প্রতি বছর দ্রাঘিমাংশ ২ সেকেন্ড করে ভাঙছে। অর্থাৎ ভাঙনের কারণে ওই এলাকায় সাগর বছরে গড়ে ২৫০ মিটার বনের ভেতরে ঢুকে পড়ছে।

বন বিশেষজ্ঞদের মতে, টেংরাগিরি বনে গাছ কেন মারা যাচ্ছে, তা জানতে দ্রুত বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান প্রয়োজন। ভাঙনরোধ ও গাছ মরে যাওয়ার বিষয়ে এখনই গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত বলে মত দিয়েছেন তাঁরা।

বরগুনা-পটুয়াখালী অঞ্চলের বিভাগীয় বন সংরক্ষক মো. সফিকুর ইসলাম গতকাল সোমবার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এখানে নতুন যোগদান করেছি। বনাঞ্চলটি পরিদর্শন করে দেখেছি, অনেক গাছ ভেঙে পড়ে আছে। আমরা এসব গাছ ওখানেই রাখার ব্যবস্থা করছি, যাতে ঢেউগুলো আছড়ে পড়ে ভাঙন ত্বরান্বিত করতে না পারে। তিনি বলেন, মূলত লোনাপানিতে প্লাবিত হওয়ায় টেংরাগিরির গাছপালার শিকড় মরে যায়। গোড়ার বালু-মাটি ক্ষয়ে যাওয়াও গাছের মৃত্যুর জন্য দায়ী।