সিলেটের সাদা পাথর ও জাফলংয়ে পর্যটকেরা কেন দুর্ঘটনায় পড়ছেন

সিলেটের জাফলংয়ে পিয়াইন নদে আজ সকালে স্কুলছাত্র মো. আল ওয়াজ আরশের লাশ ভেসে ওঠে। পরে পুলিশ লাশটি উদ্ধার করে
ছবি: প্রথম আলো

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের সাদা পাথর ও গোয়াইনঘাটের জাফলং পর্যটনকেন্দ্রে চার দিনের ব্যবধানে দুই পর্যটক গোসলে নেমে নিখোঁজের ঘটনা ঘটেছে। দুটি ঘটনাতেই দুই দিন পর তাঁদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। নিহত দুজনের মধ্যে একজন তরুণ, অন্যজন কিশোর। প্রতিবছরের বর্ষা মৌসুমে সিলেটের এ দুই পর্যটনকেন্দ্রে বেড়াতে গিয়ে পর্যটকেরা পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার একাধিক ঘটনা ঘটছে। স্থানীয় প্রশাসন, বিশ্লেষক, পুলিশ এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে এসব দুর্ঘটনার পেছনের কারণগুলো সম্পর্কে কিছু ব্যাখ্যা জানা গেছে।

গত বৃহস্পতিবার বিকেলে জাফলংয়ের পিয়াইন নদে বাবার সঙ্গে গোসলে নেমে নিখোঁজ হয় ঢাকার রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র মো. আল ওয়াজ আরশ। শনিবার সকাল সাতটার দিকে ঘটনাস্থলের পার্শ্ববর্তী স্থানে আল ওয়াজ আরশের লাশ ভেসে ওঠে। তবে এর আগে ওই এলাকায় ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল, পুলিশসহ স্থানীয় লোকজন একাধিক অভিযান চালিয়েও উদ্ধার করতে পারেনি।

এর আগে গত রোববার কোম্পানীগঞ্জের সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্রে আবদুস সালাম (২৩) নামের এক তরুণ গোসলে নেমে নিখোঁজ হয়েছিলেন। ওই ঘটনার দুই দিন পর গত মঙ্গলবার আবদুস সালামেরও লাশ ভেসে উঠেছিল।

আরও পড়ুন
নিহত স্কুলছাত্র আল ওয়াজ আরশ
ছবি: সংগৃহীত

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক জহির বিন আলম বলেন, মানুষের শরীর দৌড়াদৌড়ির পর কিংবা হাঁটাহাঁটির পর গরম হয়ে যায়। সে অবস্থায় পানিতে নামলে শরীরের মাংসপেশি ঠান্ডা হয়ে যায়। আর এমনিতে পাহাড় বেয়ে নেমে আসা পানি পাথর ছুঁয়ে ঠান্ডা অনুভূত হয়। এমন অবস্থায় পানিতে নামলে শরীর নাড়াচাড়া করা সম্ভব হয় না। এতে সাঁতার জানলেও স্রোতের টানে পানিতে চলে গিয়ে ডুবে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। এর জন্য যাঁরা সাঁতারু, তাঁরা সাঁতারে নামার আগেই শরীরের সঙ্গে পানির একটি যোগসূত্র তৈরি করেন। সাঁতারের আগে পানিতে কিছু সময় তাঁদের হাত নাড়াতে দেখা যায়। আবার হাত-পা পানিতে ভিজিয়ে নেন অনেকে। পরে পানিতে নামেন।

অধ্যাপক জহির বিন আলম বলেন, ‘পর্যটনকেন্দ্রে গিয়ে এমন দুর্ঘটনা আসলেই দুঃখজনক। এর জন্য সতর্কতা ও সচেতনতা প্রয়োজন। আমরা অনেক সময় আবেগপ্রবণ হয়ে যাই। যার কারণে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে সাঁতার না জানলেও স্রোতের পানিতে নেমে পড়ি। এতে দুর্ঘটনা ঘটে।’

এসব নদে চোরাবালি থাকার কথা নয়, জানিয়ে জহির বিন আলম বলেন, ‘পিয়াইন নদের জিরো পয়েন্ট এলাকায় চোরাবালি নেই বলেই জানি। তবে নদের শেষ মাথায় চোরাবালি রয়েছে। সেখানে বিষয়টি অবহিত করে প্রশাসনের বিলবোর্ডও রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে প্রশাসনের নজরদারি প্রয়োজন। পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে স্রোতের পানিতে যাতে কেউ না নামেন, এ জন্য বড় করে বিলবোর্ড তৈরি করে রাখা এবং প্রয়োজনে সার্বক্ষণিক একাধিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা ও মাইকিংয়ের মাধ্যমে সতর্ক করা প্রয়োজন।’

জহির বিন আলম বলেন, নদের পানিতে বালু থাকে। বালুতে দাঁড়িয়ে থাকলে স্রোতের পানির সঙ্গে পায়ের নিচের বালুগুলো সরে যায়। এতে অভ্যস্ত নন পর্যটকেরা। অনেক সময় এর ফলে ভয়ে হার্ট অ্যাটাকও করেন অনেকে।

আরও পড়ুন

ট্যুরিস্ট পুলিশ জাফলং সাব জোনের পরিদর্শক মো. রতন শেখ বলেন, জনবল কম থাকার পরও জাফলংয়ে ট্যুরিস্ট পুলিশ পর্যটকদের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে। তিনি নিজে পিয়াইন নদের জিরো পয়েন্ট এলাকায় পর্যটকেরা যাতে স্রোতের পানিতে না নামেন, সে জন্য হ্যান্ডমাইকে নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। কম জনবল দিয়ে চেষ্টার কোনো ত্রুটি না করেও এমন ঘটনা ঘটছে। পর্যটনসংশ্লিষ্ট আরও নানা কমিটি থাকলেও কাউকে সোচ্চার হতে দেখা যায় না। ফলে কার্যক্রম শুধু ট্যুরিস্ট পুলিশের ওপরই বর্তাচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারাসহ প্রশাসনের অন্যান্য শাখা থেকে সহযোগিতা করলে এমন ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর এলাকা। দুই দিকে বিশাল এলাকাজুড়ে পাথর আর মধ্যখান দিয়ে বয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছ পানি
ছবি: আনিস মাহমুদ

কোম্পানীগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা ফখর উদ্দিন। তিনি কোম্পানীগঞ্জ ফটোগ্রাফিক সোসাইটির সভাপতিও। তিনি বলেন, পর্যটকদের কোনো গাইডলাইন নেই। যে যাঁর মতো ঘুরে বেড়ান। সাদা পাথরে ট্যুরিস্ট পুলিশের কোনো স্থায়ী ক্যাম্প না থাকায় তাঁরাও বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন না। আবার নদের পানিতে থাকা পাথরগুলোর অধিকাংশই পিচ্ছিল। এতে স্রোতের মধ্যে পানিতে নেমে আনন্দ করার সময় অনেকে পা পিছলে স্রোতের টানে হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে।

ফখর উদ্দিন এর জন্য প্রশাসনকে কিছুটা কঠোর হাওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন। শুধু মুখে বলে সতর্ক করে নয়, প্রাণ বাঁচাতে প্রয়োজনে জরিমানার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

এই দুই পর্যটন এলাকার আরও কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পানিতে পাথরগুলো থাকার কারণে এতে শেওলা জমে। এ শেওলায় পা পিছলে অনেকে পড়ে যান। এ সময় পানির স্রোত বেশি থাকায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আবার কখনো পা পিছলে গিয়ে পাথরে পড়ে মাথায় আঘাত পান। এতে জ্ঞান হারিয়ে পানিতে ভেসে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে।

আরও পড়ুন

স্রোতের স্বচ্ছ পানি দেখে অনেকে লোভ সামলাতে না পেরে সাঁতার না জানলেও গোসলের জন্য পানিতে নেমে পড়েন। স্বচ্ছ পানি থাকায় গভীরতা বোঝা যায় না বলে পর্যটকেরা গভীর পানিতে চলে যান। এতে বর্ষার বাড়ন্ত পানি ভাসিয়ে নিয়ে যায়। অনেকে স্রোতের পানিতে গা ভাসিয়ে রাখেন। এ সময় স্রোতে তালিয়ে যান।

সিলেট অঞ্চলের ট্যুরিস্ট পুলিশের সুপার মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন বলেন, জনবল কম, সেটি সত্য। এরপরও পর্যটকদের নিরাপত্তার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সাদা পাথরে ট্যুরিস্ট পুলিশের ক্যাম্প স্থাপনের জন্য জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। এর বাইরে পর্যটকদেরও সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

গোয়াইনঘাট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিলুর রহমান বলেন, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একাধিকবার পর্যটনকেন্দ্রে সতর্কতামূলক বিলবোর্ড স্থাপন করা হয়েছিল। তবে বন্যার পানিতে সেগুলো ভাসিয়ে নিয়ে যায়। নদের পানি বর্ষা মৌসুমে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে জানিয়ে তিনি বলেন, এ সময় পর্যটকদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। স্রোতের পানিতে না নামতে বলা হয়। কিন্তু মানুষের মধ্যে এসব নিষেধাজ্ঞা শোনার প্রবণতা কম থাকে। শুধু পুলিশ ও প্রশাসন নয়, পর্যটকদের সচেতন ও সতর্ক করার জন্য স্থানীয় মানুষজনেরও সম্পৃক্ত হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। স্রোতের পানিতে না নামার পাশাপাশি পানিতে নামলে লাইফ জ্যাকেট পরার দিকে নজর রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

আরও পড়ুন

কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও লুসিকান্ত হাজং বলেন, সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্রে বর্ষা মৌসুমে প্রাণহানির পেছনে সতর্কতা ও সচেতনতার অভাব দেখছেন। তিনি বলেন, বর্ষা মৌসুমে হ্যান্ডমাইক নিয়ে দুজন স্বেচ্ছাসেবী সার্বক্ষণিক পর্যটনকেন্দ্রে থাকেন। তাঁরা পর্যটকদের স্রোতের পানিতে না নামার আহ্বান জানান। নৌকার ঘাটে সাইনবোর্ড দিয়ে পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ঝুঁকিপূর্ণভাবে পানিতে না নামতে নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে। এরপরও মানুষ এগুলো শুনতে চান না। পর্যটকদের সতর্ক করার জন্য ঘাটে মাইক লাগানো এবং নৌকার টিকিটের পেছনে আরও কিছু নির্দেশনা দিয়ে প্রচারণা চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।