‘গরু পানিতে ডুইব্বা আমাগো তো সব শেষ হইয়া গেছে’

মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলায় গতকাল নিজেদের পাঁচটি গরু মারার পর গোয়ালঘরে একটি বাছুরকে ধরে বিলাপ করে কাঁদছিলেন রিমা বেগম। আজ সকালে হোসেন্দি ইউনিয়নের ভাটি বলাকী গ্রামেছবি: প্রথম আলো

‘ছয়ডা গাই বাছুর আছিলো। পোলাপাইনের মতো যত্ন কইরা পালতাম। এইর মইধ্যে দুইডা গরু ৫ কেজি কইরা ১০ কেজি দুধ দিত। হেই দুধ বেইচ্চা আমাগো সংসার চলতো, দুই পোলামাইয়ার পড়ালেহা চলতো। গরু পানিতে ডুইব্বা আমাগো সব শেষ হইয়া গেলো!’

বিলাপ করে আজ শনিবার সকালে কথাগুলো বলছিলেন মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় উপজেলার হোসেন্দি ইউনিয়নের ভাটি বলাকী গ্রামের বাসিন্দা রিমা বেগম। তিনি একই এলাকার মহসিন মিয়ার স্ত্রী। গতকাল শুক্রবারও এই দম্পতির গোয়ালঘরে বিভিন্ন বয়সী ছয়টি গরু ছিল। গতকাল বিকেলে খালে জোয়ারের পানি ও কচুরিপানার চাপে তাঁদের ৫টি গরুসহ মোট ২৯টি গরু মারা গেছে। গরু হারিয়ে জীবন–জীবিকা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে কয়েকটি পরিবার।

আরও পড়ুন

আজ সকালে রিমার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙা গোয়ালঘরে ছোট্ট একটি বাছুরকে ধরে বসে বসে কাঁদছেন। একপর্যায়ে রিমা বলেন, ‘৮-১০ বছর অন্য মানুষের গরু বর্গা আইন্না পালছি। ধারদেনা কইরা একটা গরু কিনছিলাম। ওই গরু দিয়া তিল তিল কইরা ঘরটা ভইরা ফালাইছিলাম। চাইরজনের সংসার, দুই পোলাপাইনের সব খরছ গরুর রোজগার দিয়াই চলতো। এই গুলাই আমাগো সম্পদ আছিলো। চোখের সামনেই সব শেষ হইয়া গেলো।’

রিমা-মহসিন দম্পতির মতোই নিজেদের এক বা একাধিক গরু হারিয়ে এখন দিশাহারা গ্রামটির আরও ১৮টি পরিবার। শুক্রবার খাল পার হতে গিয়ে কচুরিপানার চাপ আর জোয়ারের পানিতে ডুবে স্থানীয় বাসিন্দা নাহিদ ইসলাম ও ইয়ানূর হোসেনের ৩টি করে মোট ৬টি, এম আর হোসেনের দুটি, মাসুম মিয়ার একটি, আবুল হোসেনের ৩টি, শাহজালালের ৩টি, কবির হোসেন খানের ৩টি, শরিফ হোসেনের ৩টি, তরিকুল ইসলামের ২টিসহ মোট ২৯টি গরুর মৃত্যু হয়েছে।

রোজগারের একমাত্র অবলম্বন একটি গাভি মারা যাওয়ায় শূন্য গোয়ালঘর দেখিয়ে কাঁদছিলেন এম আর হোসেন
ছবি: প্রথম আলো

স্থানীয় বাসিন্দা ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভাটি বলাকী গ্রামের অধিকাংশ মানুষ কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। প্রায় সবার গরু রয়েছে। গ্রামের মানুষ প্রতিদিন গ্রামসংলগ্ন চরে খাল পাড়ি দিয়ে শতাধিক গরু ঘাস খাওয়াতে নিয়ে যান। ঘাস খেয়ে প্রতিদিন বিকেলে গরুগুলো আবার গোয়ালঘরে ফিরে আসে। শুক্রবার বিকেলে খাল জোয়ারের পানিতে ভরে যায়। কচুরিপানায়ও পূর্ণ হয়ে যায়। বিকেলে চর থেকে গরু খাল পার হচ্ছিল। সে সময় জোয়ারের পানির স্রোতে এবং কচুরিপানার চাপে গরুগুলো তলিয়ে যায়।

আজ সকালে নদীবেষ্টিত গ্রামটিতে গিয়ে দেখা যায়, যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে সেই খালের দিকে উদাসীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে কয়েকজন নারী-পুরুষ। তখনো মৃত গরুগুলোর কয়েকটি খালপাড়ে পড়ে ছিল। গ্রামের বাসিন্দাদের ছোট ছোট এক ও দুইচালা টিনের ঘর। এসব ঘরের পাশেই আছে বাঁশ, কাঠ ও প্লাস্টিকের নেটের তৈরি গোয়ালঘর। অনেকেই নিজেদের জীবন-জীবিকার একমাত্র অবলম্বন গরু-বাছুর হারিয়ে বিষণ্ন মনে এসব গোয়ালঘরে বসে ছিলেন। তাঁদের একজন জহুরা বেগম।

জহুরা বেগম বলেন, ‘আমার দুইটা বড় গাভি ও একটা ষাঁড় গরু ছিল। চোখের সামনে গুরুগুলো ডুবেছিল। আমি গরু বাঁচাইতে গিয়া নিজেও ডুইব্বা গেছিলাম। অল্পের জন্য বাইচ্চা আইছি। কীভাবে সংসার চলব, জানি না। আমাগো বাইচ্চা থাইকা এহন মরার মতো।

একই অবস্থা এখন ওই গ্রামের শরিফ হোসেনের। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘আমাদের তিনটা গরু মারা গেছে। গরুর ঘরে যাইতে পারি না। কষ্টে বুক ফাইট্টা যায়। বউ-বাচ্চাগো মুহের দিকে চাইতে পারি না।’

গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা সুজন জানান, গতকালের ওই দুর্ঘটনায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশ বেশ গরিব। এই পরিবারগুলোর পথে বসার উপক্রম হয়েছে। সরকারি বা বেসরকারিভাবে পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানো উচিত। নইলে তারা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে।

ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সঙ্গে দেখা করে সহযোগিতার আশ্বাস দেন হোসেন্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুল হক
ছবি: প্রথম আলো

একই কথা জানান হোসেন্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের ইউনিয়ন পরিষদের তহবিল ও ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে ওই মানুষগুলোর সহযোগিতার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার তহবিলে এক লাখ টাকার অনুদান দেওয়া হয়েছে। যাঁরা আর্থিকভাবে সচ্ছল আছেন, তাঁরা হাত বাড়িয়ে দিলে এবারের মতো এমন দুর্ঘটনা ধাক্কা সামলে নিতে পারত পরিবারগুলো।

জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের সমন্বয়ে তহবিল গঠন করে দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন গজারিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আশরাফুল আলম। তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের এমনভাবে সহায়তার চেষ্টা চলছে, যেন পরিবারগুলো কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়াতে পারে।