পুরোনো রূপে ফিরেছে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী সারদা হল

নতুনভাবে ছাদ ঢালাই, মঞ্চ নির্মাণ, বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা চালু, বসার চেয়ার কেনাসহ নানা কিছুই করতে হয়েছে।

সিলেটের ঐতিহ্যবাহী সারদা হল। গত বুধবার তোলা
ছবি: প্রথম আলো

কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের আদলে ৮৭ বছর আগে সিলেট শহরে সুরমা নদীর পাড় ঘেঁষে নির্মিত হয় সারদা স্মৃতি ভবন নামের একটি মিলনায়তন। এর পর থেকেই নানা সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় এখানে মঞ্চ মাতাতেন শিল্পীরা।

আশির দশকে মিলনায়তনটি ব্যবহারের অনুপযোগী হওয়ার দীর্ঘদিন পর তা সংস্কার করা হয়েছিল। তবে সর্বশেষ ১১ বছর ধরে মিলনায়তনটি অনেকটা ‘পরিত্যক্ত’ অবস্থায় আছে। সংস্কৃতিকর্মীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি মিলনায়তনটি সংস্কার করে ব্যবহারের উপযোগী করা হয়েছে। ২১ সেপ্টেম্বর থেকে পুনরায় মিলনায়তনটি ব্যবহারে সংস্কৃতিকর্মীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে মিলনায়তনের তত্ত্বাবধায়নের দায়িত্বে থাকা সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ।

সংস্কৃতিকর্মীরা জানান, মঞ্চে আবার আগের মতো আলো জ্বলবে, শিল্পীদের দরাজ কণ্ঠে মুখর হবে মিলনায়তন। এতে সিলেটের সর্বস্তরের সংস্কৃতিকর্মীরা উজ্জীবিত।

সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের সভাপতি রজতকান্তি গুপ্ত জানান, গত ১১ বছর ধরে মিলনায়তনটি অনেকটা ভাগাড় হিসেবেই ব্যবহার করত সিটি কর্তৃপক্ষ। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সারদা হল সংস্কার করে চালু করার দাবিতে সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেট প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে। ওই দিন কর্মসূচিতে উপস্থিত হয়ে সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী মিলনায়তনটি সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেন।

রজতকান্তি গুপ্ত জানান, ২০ সেপ্টেম্বর সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেট ৪০ বছরে পদার্পণ করবে। এ উপলক্ষে বছরব্যাপী কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। এরই অংশ হিসেবে ২০ সেপ্টেম্বর সারদা হল প্রাঙ্গণে উদ্বোধনী পর্ব এবং সারদা হলের ভেতরে ২১ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর তিন দিনব্যাপী নাট্য প্রদর্শনী হবে। এর মধ্য দিয়ে সারদা হলটি আবার সংস্কৃতিচর্চার জন্য উন্মুক্ত হবে।

সিলেট নগরের কিনব্রিজ-সংলগ্ন এলাকায় ৩৯ শতক জায়গাজুড়ে সারদা স্মৃতি ভবনের অবস্থান। স্বদেশি আন্দোলনের নেতা, আইনজীবী, শিক্ষানুরাগী ও চা ব্যবসায়ী সারদাচরণ শ্যামের (১৮৬২-১৯১৬) স্মৃতি রক্ষার্থে তাঁর ছোট ভাই বিমলাচরণ শ্যাম মিলনায়তনটি স্থাপন করেন। ১৯৩৬ সালের ২০ জানুয়ারি মিলনায়তনের উদ্বোধন করেন ভারতের আসাম প্রদেশের তৎকালীন গভর্নর স্যার মাইকেল কিন। মিলনায়তনের নাম ‘সারদা স্মৃতি ভবন’ হলেও এটি সারদা হল নামেই পরিচিতি পেয়েছে।

সিটি করপোরেশন ও সংস্কৃতিকর্মীদের সূত্রে জানা গেছে, সে সময় সারদা হল তৈরিতে প্রায় এক লাখ টাকা ব্যয় হয়েছিল। এর পুরো টাকাই দিয়েছিল শ্যাম পরিবারের পরিচালনাধীন ইন্দেশ্বর টি অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড। নির্মাণসামগ্রী কলকাতা থেকে জাহাজে করে সিলেটে আনা হয়েছিল। তবে আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের অভাবে মিলনায়তনটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছিল।

২০০৫ সালের ২৮ মে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের নির্দেশনায় মিলনায়তনের মূল অবকাঠামো ও অবয়ব ঠিক রেখে সিলেট জেলা পরিষদ সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। সংস্কার শেষে ২০০৬ সালের ১ এপ্রিল ভবনের উদ্বোধন হয়। ২০১২ সালে পুরোনো নগর ভবন ভেঙে নতুন ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হলে সিটি করপোরেশনের পরিচালনাধীন ‘পীর হবিবুর রহমান পাঠাগারে’ করপোরেশনের কার্যালয় অস্থায়ীভাবে স্থানান্তর করা হয়। তখন পাঠাগারের যাবতীয় বই সারদা হলে স্তূপাকারে রাখা হয়।

সিটি করপোরেশনের নতুন ভবনের উদ্বোধন শেষে ২০১৮ সালে অস্থায়ী কার্যালয়টি পুনরায় স্থানান্তর করে স্থায়ী কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হলেও সারদা হলে রাখা পাঠাগারের বই সরানো হয়নি। উল্টো এ ভবন ভাগাড়ে পরিণত করার পাশাপাশি সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ ভবনের প্রাঙ্গণে বিভিন্ন ধরনের যানবাহন রেখে অস্থায়ী স্ট্যান্ডে পরিণত করে।

সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল শাখা সূত্রে জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারিতে সারদা হল থেকে মালামাল সরিয়ে সংস্কারকাজ শুরু করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত থাকায় মিলনায়তনের অনেক কিছুই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছিল। ফলে নতুনভাবে ছাদ ঢালাই, মঞ্চ নির্মাণ, বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা চালু, বসার চেয়ার কেনাসহ নানা কিছুই করতে হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৬০ লাখ টাকা।

মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, সিলেটের সংস্কৃতিচর্চা বেগবান রাখতে পুনরায় সারদা হল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।