‘একমুহূর্তে আমার সব শেষ হয়ে গেল’

ট্রলার দুর্ঘটনায় স্ত্রী ও দুই মেয়েকে হারিয়ে বারবার ডুকরে কেদে উঠছিলেন মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার দক্ষিণফুলদি গ্রামের মফিজুল হক।স্বজনরা তাঁকে পাশে থেকে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছেন
ছবি: প্রথম আলো

‘দুই মেয়ে মাওয়া, সাফা ও স্ত্রী সুমনাকে নিয়ে আমার সুখের সংসার ছিল। আনন্দে কাটছিল আমাদের দিন। সংসারে কোনো কিছুর কমতি ছিল না। অথচ একমুহূর্তে আমার সব শেষ হয়ে গেল। বাল্কহেড সবাইকে কেড়ে নিল।’ আজ রোববার দুপুরে ভাঙা কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের চরকিশোরগঞ্জে মেঘনা নদীতে বাল্কহেডের ধাক্কায় ট্রলারডুবির ঘটনায় স্ত্রী ও দুই সন্তান হারানো মফিজুল হক।

কথা বলার সময় বারবার ঢুঁকরে কেঁদে উঠছিলেন মফিজুল। বলছিলেন, ‘আমার তো আর কেউ থাকল না। কত আনন্দ নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলাম। কে জানত এমন ঘটনা আমার জীবনে ঘটে যাবে। আমার পূর্ণ জীবন শূন্য হয়ে যাবে। সুখের ঘর বিরান হয়ে যাবে।’

আরও পড়ুন

গত শুক্রবার বিকেলে মফিজুল হক তাঁর স্ত্রী, সন্তান, স্বজনসহ ১১ জন নিয়ে ট্রলারে করে মেঘনা নদীতে ঘুরতে বের হন। ঘুরতে ঘুরতে তাঁদের ট্রলার নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের চরকিশোরগঞ্জ এলাকায় পৌঁছায়। ট্রলারটি সন্ধ্যার পর ট্রলারটি গজারিয়ার দিকে যাচ্ছিল। সে সময় নারায়ণগঞ্জ থেকে বালু নিতে মুন্সিগঞ্জের বালুমহালের দিকে আসা একটি বাল্কহেড ট্রলারটিকে ধাক্কা দিলে ১১ যাত্রী নিয়ে ডুবে যায়। স্থানীয় ব্যক্তিদের সহযোগিতায় মফিজুল হকসহ পাঁচজন তীরে উঠতে পারলেও মফিজুলের স্ত্রী, দুই মেয়ে মাওয়া ও সাফাসহ ছয়জন নিখোঁজ হন।

ঘটনার পরদিন গতকাল শনিবার সকালে মফিজুল হকের স্ত্রী সুমনা আক্তারের (৩০) লাশ উদ্ধার করা হয়। আজ রোববার সকাল সাতটার দিকে মফিজুলের বড় ভাই বোরহান উদ্দিন কাজীর মেয়ে জান্নাতুল মারওয়া (৮), সকাল ১০টার দিকে মফিজুলের ভায়রা সাব্বির হোসাইনের (৪০) লাশ মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার চরঝাপটা এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়। বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার চর রমজানবেগ এলাকা থেকে বিআইডব্লিউটিএ ও নৌ পুলিশের একটি দল উদ্ধার করে মফিজুলের বড় মেয়ে জান্নাতুল মাওয়ার (৬) লাশ। এখনো নিখোঁজ তাঁর ছোট মেয়ে সাফা আক্তার (৪) এবং সাব্বিরের ছেলে রিমাদ (২)।

আজ দুপুরে দক্ষিণ ফুলদি এলাকার মফিজুল হকদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে উৎসুক মানুষের জটলা। বাড়ির বাইরে বিভিন্ন কোনায় বসে মানুষ দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের স্মৃতিচারণা করছেন। কেউ কেউ নিহত ব্যক্তিদের স্মৃতিচারণা করে নীরবে কাঁদছিলেন। বাড়ির এক কোনায় সকালে উদ্ধার হওয়া মারওয়ার লাশকে দাফনের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছিল। ঘরের বাইরে আরেক পাশে বসেছিলেন দুর্ঘটনায় নিহত মারওয়ার বাবা বোরহানউদ্দিন কাজী। তাঁকে আত্মীয়স্বজনেরা বিভিন্নভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। বোরহান উদ্দিন কাজী শোকস্তব্ধ হয়ে বসেছিলেন।

পাঁচ মাস আগে ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বোরহান কাজীর স্ত্রী জুলেখা বেগম। বোরহান কাজীর দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে মারওয়া ছিল সবচেয়ে ছোট। মারওয়া স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত। বড় দুই ভাই-বোন ঢাকায় থেকে পড়াশোনা করেন।

মেয়ের প্রসঙ্গ উঠতেই বোরহান উদ্দিন কাজী বলেন, ‘মারওয়ার মা মারা যাওয়ার পর থেকে মফিজুলের ঘরেই বেশি সময় থাকত মেয়েটা। সারা দিন কাজের জন্য বাইরে থাকতাম। ঘরে ফিরে যখন একা থাকতাম, মারওয়াকে দেখে সব কষ্ট ভুলে থাকতাম। শুক্রবার বিকেলে ঘরে শুয়ে ছিলাম। সেদিন মেয়ে বারবার আমাকে বলছিল, “বাবা, তোমাকে একটা কথা বলব, তুমি কথা রাখবা, ওয়াদা করো।” এভাবে আমাকে অন্তত ১০ থেকে ১২ বার সে ওয়াদা করায়। সেদিন বিকেলে চাচা-চাচিদের সঙ্গে ট্রলারে ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে। মা মরা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আমিও আর না করতে পারিনি। যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিল বাবা, যাই। কে জানত, আমার মেয়েটার এই যাই বলাটাই শেষ ছিল। আর ফিরে আসবে না।’

বোরহান উদ্দিন কাজীদের স্বজন কাউসারুল ইসলাম ভূইয়া। তিনি কখনো ঘরে, কখনো বাইরে এসে আপনজন হারা মফিজুল-বোরহান কাজীদের সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছিলেন। কাউসারুল ইসলাম বলেন, বোরহান পাঁচ মাস আগে তাঁর স্ত্রীকে হারালেন। এর পর থেকে মারওয়াসহ মফিজুলের পরিবারের সঙ্গেই থাকছিলেন তাঁরা। মফিজুলের স্ত্রী সুমনা বোরহানকে বড় ভাই ও মারওয়াকে নিজের দুই মেয়ের মতো করেই লালন-পালন করছিলেন। তাঁদের সংসারের সব শেষ হয়ে গেল। মফিজুল তো তাঁর পুরো পরিবারকে হারাল। এমন কষ্ট মেনে নেওয়ার মতো নয়।

সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে মফিজুল হক বলেন, ‘সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। ঠিকঠাক মতোই আমরা নদী পার হওয়ার জন্য রওনা দিয়েছিলাম। বালুবাহী বাল্কহেড আমাদের ট্রলারের দিকে আসছিল। আমাদের ট্রলার থেকে আমরা তাদের ইশারা করলাম। এরপরও বাল্কহেড ট্রলারটিকে ধাক্কা দিয়ে ডুবিয়ে দিল। বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করলাম, কেউ আমাদের বাঁচাতে এল না। চরকিশোরগঞ্জ ঘাটে কয়েকটি ট্রলার ছিল, তারা যদি সময়মতো আসত, হয়তো আমি আমার আপনজনদের হারাতাম না।’