স্কুলের ছুটিতে মা-বাবা আর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে বেড়াতে গেছে মাইসুন। ২০২৩ সালের কথা। দুবাই শহরের একটি শপিং মল থেকে কেনাকাটা শেষে পার্কিংয়ে এসেছে তারা গাড়িতে উঠবে বলে। সেখানে কর্মরত এক শ্রমিক ছুটে এলেন মাইসুনকে দেখে। প্রবাসী ওই শ্রমিকের বাড়ি চট্টগ্রামের আনোয়ারায়। তাঁর সন্তানেরা এবং তিনি নিজেও মাইসুনের ভিডিও দেখেন। তাই বিদেশের মাটিতে মাইসুনকে সামনে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা। সেলফি তুলেও শেষ হয়নি আবদার। বায়না ধরলেন, মাইসুন আর তার পরিবারকে আপ্যায়ন করাবেন।
সবিনয়ে নিষেধ করার পর পকেট থেকে বের করে ১০ দিরহাম তুলে দিলেন মাইসুনের হাতে। না নিলে ভীষণ কষ্ট পাবেন বলে জানালেন। অগত্যা নিতেই হলো। প্রবাসী শ্রমিকের সেই ১০ দিরহামের নোটটি ভালোবাসার স্মারক হিসেবে এখনো নিজের কাছে রেখে দিয়েছে মাইসুন।
চট্টগ্রামের মেয়ে উম্মে মাইসুন বাংলাদেশ মহিলা সমিতি উচ্চবিদ্যালয়ের বাংলা মাধ্যমের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। গ্রামের বাড়ি রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সৈয়দ বাড়িতে। ১৫ বছর বয়সী এই খুদে ইনফ্লুয়েন্সারের বিশ্বজোড়া ভক্ত-অনুসারী। সবাই তাকে চেনে ‘মাইসুনস ওয়ার্ল্ড’ নামে। তা দেশে হোক কিংবা বিদেশে, অল্প সময়ের মধ্যেই কেউ না কেউ এসে হাজির হয় সেলফি তোলার জন্য। মাইসুনও কাউকে নিরাশ করে না। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সব বয়সীদের মধ্যেই মাইসুনের অনুসারী রয়েছে। কেবল ইংরেজি ভাষা শেখার জন্য নয়, ইদানীং ছোট ভাই জুবরানের কিউট কিউট সব দুষ্টুমি ভরা সংলাপের কারণেও মাইসুনের ভিডিওর দর্শক বাড়ছে। ছোট জুবরানের নিজের আলাদা ফেসবুক পেজ আছে। জুবরানস ওয়ার্ল্ড নামের ওই পেজে ফলোয়ার ৩ লাখ ৬ হাজার।
যোগাযোগের বৈশ্বিক ভাষা ইংরেজির প্রতি এ দেশের শিশুদের মনে একটা ভীতি ছোটবেলা থেকেই জেঁকে বসে। ভাষার এই বাধা অনেকের জীবনেই স্থায়ী হয়। মাইসুন শিশুদের মন থেকে এই ভীতি একেবারেই দূর করে দিয়েছে। মাইসুনের কথা শুনলে, ভিডিও দেখলে ও বই পড়লে মনে হবে ইংরেজি আসলেই ‘ডাল–ভাত’।
১৫ বছর বয়সী এই খুদে ইনফ্লুয়েন্সারের বিশ্বজোড়া ভক্ত-অনুসারী। সবাই তাকে চেনে ‘মাইসুনস ওয়ার্ল্ড’ নামে। তা দেশে হোক কিংবা বিদেশে, অল্প সময়ের মধ্যেই কেউ না কেউ এসে হাজির হয় সেলফি তোলার জন্য। মাইসুনও কাউকে নিরাশ করে না।
যেভাবে শুরু
মাত্র ৯ বছর বয়সে ইউটিউবে ইংরেজি শেখানো শুরু করে মাইসুন। প্রথম ভিডিওর নাম ছিল ‘ঘরে খেলতে খেলতে ইংরেজিতে কথা বলতে শেখা’। ভিডিওটি ইন্টারনেটে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই অনুসারীর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। ইংরেজি বলতে যাদের ভয় বা লজ্জা, তারা যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ল মাইসুনের ভিডিও দেখতে।
কখন কোন শব্দের আগে কোন প্রিপোজিশন বসবে, কখন ‘অন’, ‘অ্যাট’ বসবে বা রেস্তোরাঁয় গেলে কীভাবে খাবারের মেনু দেখে অর্ডার করতে হবে, এসব টুকিটাকি ইংরেজি সবাই যেন গোগ্রাসে গিলতে লাগল। কোন শব্দের ব্যবহারে কথ্য ইংরেজিটা আরও বোধগম্য হবে, সেই টিপসও মিলছে মাইসুনের কাছ থেকেই।
যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরে দুই দশক ধরে বাস করছেন চট্টগ্রামের ফয়’স লেক এলাকার বাসিন্দা কবির চৌধুরী। সম্প্রতি দেশে এসে এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কথা বলছিলেন তিনি। হঠাৎ বললেন, ‘জানেন, আপনাদের শহরে একটি মেয়ে আছে, মাইসুন। বাংলা মাধ্যমে পড়ে। কথা বলে অবিকল ব্রিটিশ অ্যাকসেন্টে। তাহলে ইংরেজিতে দক্ষতা অর্জন যে কোনো বড় বিষয় নয়, তা তো প্রমাণিত। তবু এত শিক্ষার্থী কেন ইংরেজিতে খারাপ করে, সেটাই প্রশ্ন।’
কখন কোন শব্দের আগে কোন প্রিপোজিশন বসবে, কখন ‘অন’, ‘অ্যাট’ বসবে বা রেস্তোরাঁয় গেলে কীভাবে খাবারের মেনু দেখে অর্ডার করতে হবে, এসব টুকিটাকি ইংরেজি সবাই যেন গোগ্রাসে গিলতে লাগল। কোন শব্দের ব্যবহারে কথ্য ইংরেজিটা আরও বোধগম্য হবে, সেই টিপসও মিলছে মাইসুনের কাছ থেকেই।
ইনফ্লুয়েন্সার মাইসুন
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ৯ বছর বয়সে ডিজিটাল মাধ্যমে যাত্রা শুরু মাইসুনের। এখন ফেসবুকে তার ফলোয়ার সংখ্যা ৪০ লাখের মতো, আর ইউটিউবে ১১ লাখ, ইনস্টাগ্রামে ২ লাখ ৬৫ হাজার, টিকটকে ১ লাখ ৯৪ হাজার। সব মিলিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ৫৫ লাখ ফলোয়ার। শুরুতে রবি টেন মিনিটস স্কুলের সঙ্গে কাজ করেছিল মাইসুন। তখন বাংলাদেশের সবচেয়ে কনিষ্ঠ অনলাইন শিক্ষকের খেতাবও পেয়েছে সে।
ভিডিও তৈরিতে মা-বাবা দুজনের সমান সহায়তা পায় মাইসুন। তবে ভিডিওর কনটেন্ট নিয়ে ভাবনাটা মাইসুনের নিজের। মাইসুনের কনটেন্ট সব বয়সীদের কাছেই জনপ্রিয়। তার ‘ইংরেজিতে কথা বলার শুরুর ৩৮টি বাক্য’ শিরোনামের ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ৪ কোটি ১০ লাখ বার দেখা হয়েছে এই পর্যন্ত। ২ লাখ ৩৩ হাজার বার শেয়ার হয়েছে ভিডিওটির। মাসে গড়ে ইউটিউব ও সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রায় ৩ কোটিবার দেখা হয় তার ভিডিও। গত পাঁচ বছরে ৭১৭টি কনটেন্ট আপলোড হয়েছে মাইসুনের ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেজে।
ইংরেজি শেখার শুরু যেভাবে
মাইসুনের ইংরেজি শেখার শুরুর কথা জানা যাবে তার লেখা বই ছোটদের ‘স্পোকেন ইংলিশের’ ভূমিকায়। সেখানে মাইসুন লিখেছে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি শেখার দরকার হয়ে পড়ল। কারণ, তার সমবয়সী দুই খালাতো বোন লাইবা ও জুয়ারিয়া থাকে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টারে। প্রতিবছরই দেশে আসে তারা। তাদের সঙ্গে খেলাধুলা ও ভাববিনিময়ে ভাষাটা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। বোনদের সঙ্গে সহজ মেলামেশার ইচ্ছা থেকেই মাইসুন ইংরেজি শেখার উদ্যোগ নেয়। শুরুতে কার্টুন, পরে কমিকস আর গল্পের বই ছিল তার শেখার উপকরণ। ‘বেন অ্যান্ড হোলি’ আর ‘পেপাপিগ’ কার্টুন তো আছেই, তার পাশাপাশি মাইসুন পড়েছে ‘হ্যারি পটার’, ‘জেরিনিমো স্টিলটন’, ‘প্রিন্সেস ডায়েরিস’, ‘থিয়া স্টিলটন’ সিরিজের বই। বিষয়টা বিস্ময়করই বটে। আমরা শৈশবে ইংরেজি শিখেছি গ্রামার ধরে ধরে। ভার্ব প্লাস জিরান্ড দিয়ে বাক্য রচনার কথা অনেকেরই নিশ্চয় মনে আছে। তবে মাইসুনের শিখনপদ্ধতি একেবারেই আলাদা। ভাষা শেখার এই পদ্ধতিকে বলে ‘টোটাল ইমারশন মেথড’। অর্থাৎ ডুবে গিয়ে গা ভেজানোর পদ্ধতি। ভাষার সাগরে ডুবলে শরীর তো ভিজবেই। আর ভাষাটা তাতেই আয়ত্তে আসবে।
মাইসুনের মা উম্মে সালমা চৌধুরীর কথায়ও এই গা ভিজিয়ে শেখার বিষয়টা যেন আরও খোলাসা হলো। তিনি বললেন, মাইসুনের জন্য ইংরেজি শেখার কোনো বই কেনা হয়নি। কোনো টিউটরও ছিল না। গ্রামার বইয়ের সাহায্য ছাড়াই সে ইংরেজি বলা শিখেছে গল্পের বই পড়ে আর কার্টুন দেখে।
আসলে আমরা বড়রা যা শিখতে পারি, ছোটরা তার চেয়েও সহজে অনায়াসে সেসব শিখে যায়। শিখনপ্রক্রিয়ার মধ্যে দেখা, অভিজ্ঞতা সঞ্চয়, মনে রাখা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে ধাপগুলো আছে, সেসব শিশুরা সহজেই অতিক্রম করতে পারে। মাইসুনের ক্ষেত্রেও তা হয়েছে।
মাইসুনের শিখনপদ্ধতি একেবারেই আলাদা। ভাষা শেখার এই পদ্ধতিকে বলে ‘টোটাল ইমারশন মেথড’। অর্থাৎ ডুবে গিয়ে গা ভেজানোর পদ্ধতি। ভাষার সাগরে ডুবলে শরীর তো ভিজবেই। আর ভাষাটা তাতেই আয়ত্তে আসবে।
লেখক মাইসুন
মাইসুনের লেখা ‘ছোটদের স্পোকেন ইংলিশ’-এর চারটি খণ্ড বেরিয়ে গেছে এর মধ্যে। বই প্রকাশের আগে প্রকাশনা থেকে মাইসুনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তিও করা হয়। এ জন্য অগ্রিম লেখক সম্মানীও পায় সে।
কেবল ছোটদের ইংরেজি শিক্ষা নয়, এর মধ্যে ইংরেজিতে দুটি উপন্যাসও লিখেছে মাইসুন। মাত্র ১১ বছর বয়সে মাইসুনের প্রথম উপন্যাস ‘দ্য এমারেলেন্ড স্টোন’ প্রকাশিত হয়। ১৪ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় থ্রিলার উপন্যাস ‘আনওয়ান্টেড রিভেঞ্জ’, যা অনেক কিশোর-কিশোরীর প্রিয় বই হয়ে উঠেছে।
মাইসুন পড়তে, বেড়াতে আর ছবি আঁকতে ভালোবাসে। থ্রিলার সিরিজ, কমিকসের পাশাপাশি সাহিত্যের প্রতিও আগ্রহ আছে মাইসুনের।
মাইসুনের অর্জন
শিক্ষামূলক কনটেন্ট তৈরির জন্য মাইসুন বেশ কিছু স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০২৩ সালে মার্ভেল অ্যাওয়ার্ড পায় ইন্সপায়ারিং চিলড্রেন হিসেবে। এ ছাড়া সে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটিতে আয়োজিত টেডএক্স অনুষ্ঠানে সবচেয়ে কম বয়সী বক্তা হিসেবে বক্তব্য দেয়।
ইংরেজি শিক্ষা আর লেখালেখি নয়, মাইসুন এ বয়সেই নারীদের বিশেষ করে কিশোরীদের স্বাস্থ্য নিয়েও কাজ শুরু করেছে। অ্যাওয়ারনেস ৩৬০ নামের একটি বৈশ্বিক সংগঠনের সহায়তায় সে কিশোরীদের মাসিক স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতন করার জন্য একটি সামাজিক সচেতনতা প্রকল্প পরিচালনা করছে।
২০২৩ সালে মাইসুন চট্টগ্রামের একটি বস্তি ও কক্সবাজারের জলবায়ু উদ্বাস্তুদের বসতবাড়ি দেখতে যায়। যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঘরবাড়ি হারানো মানুষেরা অতি কষ্টে জীবন যাপন করছিল। সেখানকার কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে স্বাস্থ্যশিক্ষা, চিকিৎসা নিয়ে কথা বলেছে মাইসুন। বিনিময় করেছে নিজের অভিজ্ঞতা। জুগিয়েছে পথ পাড়ি দেওয়ার সাহস।
এই সমাজসেবামূলক কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ৭৬টি দেশের ২১৬ জন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে মাইসুন অ্যাওয়ারনেস ৩৬০-এর ‘ফেলো অব দ্য ইয়ার’ সম্মাননা অর্জন করে। কেবল তা-ই নয়, সবচেয়ে কম বয়সী পরিবর্তনকারী (Youngest Changemaker) হিসেবে আরও আটজনের সঙ্গে মাইসুনের নাম ওঠে তালিকায়। মাইসুন এখন কাজ করছে শিক্ষামূলক সংগঠন এক টাকায় শিক্ষার শুভেচ্ছাদূত হিসেবে।
মানুষের সঙ্গে, মানুষের জন্য
শিশুদের সম্পর্কে আইরিশ শিল্পী স্টাশিয়া টাউশারের একটা বিখ্যাত উক্তি এমন, ‘একটা শিশু ভবিষ্যতে কী হবে, তা নিয়ে আমরা এমন ভাবিত থাকি যে সে এখনই যে বিশেষ একজন, সেটা খেয়াল করি না।’ স্টাশিয়া যেন মাইসুনকে উদ্দেশ করেই কথাগুলো বলেছিলেন। চট্টগ্রাম নগরের বাসায় বসে কথা হচ্ছিল মাইসুনের সঙ্গে। জানতে চাই কোথায় দেখতে চাও নিজেকে? মাইসুনের চটজলদি উত্তর, মানুষের মাঝে।
বিষয়টা আরও পরিষ্কার করার জন্য সে বলে, ‘এখন অনেক শিশুই আমাদের প্ল্যাটফর্ম থেকে শিখছে। স্বাস্থ্য সচেতনতাসহ অনেক কাজ করছি আমরা। আমি চাই একটা লাইভ ক্লাসরুম হবে। শেখানোর পরিসর আরও বড় করতে চাই। সবাই উপকৃত হয়, এমন কাজ করে যেতে চাই। আর এগিয়ে নিতে চাই নারীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার কার্যক্রম।’