‘প্রতিটি দিনই তোমাকে মিস করি বাবা’

২০১৪ সালের ২০ মে রাতে সাংবাদিক সদরুল আলমকে বাড়ি থেকে কৌশলে ডেকে নিয়ে নৃশংসভাবে কুপিয়ে খুন করে দুর্বৃত্তরা। 

চুয়াডাঙ্গার নিহত সাংবাদিক সদরুল আলমের স্ত্রী নিলুফা ইয়াসমিন ও মেয়ে সানিয়া এমামন। ১৮ জুন বিকেলে তাঁদের বাড়িতে
ছবি: প্রথম আলো

‘সবাই বাবা দিবসে তাদের বাবাদের নিয়ে আনন্দ–উল্লাসে মেতে থাকে। কিন্তু আমার সেই সৌভাগ্য নেই। বাবাকে হারানো মানে মাথার ওপরে ছাদ হারিয়ে ফেলা। বাবা নামের ছায়াটা জীবন থেকে অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছি। বাবার অভাবটা বড্ড বেশি অনুভব করছি। বড্ড মিস করছি। তোমার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা করলেও সেটা আর সম্ভব নয়। পৃথিবীতে যার বাবা নেই, সেই বোঝে, তার বাবার ভালোবাসা তার জন্য কত প্রয়োজন।’

ওপরের লাইন কটি কিশোরী সানিয়া এমামনের ডায়েরির পাতা থেকে নেওয়া। দুর্বৃত্তের নৃশংসতায় নিহত সাংবাদিক সদরুল আলমের (নিপুল) একমাত্র সন্তান সানিয়া। ১৮ জুন বিশ্ব বাবা দিবসে ৯ বছর আগে হারানো বাবাকে নিয়ে অনুভূতিগুলো এভাবে কথামালায় ডায়েরির পাতায় সাজিয়েছে মেয়েটি। সানিয়া মোমিনপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী।

বাবার শূন্যতা নিয়ে সানিয়া সেখানে আরও লিখেছে, ‘বাবার অপূর্ণতা পৃথিবীর কোনো কিছু দিয়েই পূর্ণ করা সম্ভব নয়। বাবাকে হারিয়ে বুঝতে পেরেছি যে কত মূল্যবান একটা জিনিস হারিয়ে ফেলেছি। বিশেষ করে একটি মেয়ের লাইফে তার বাবাকে যে কতটা দরকার, সেটা প্রতিটি পদক্ষেপে অনুভব করি। আমি প্রতিটি দিনই তোমাকে মিস করি বাবা…’

২০১৪ সালের ২০ মে রাতে সাংবাদিক সদরুল আলমকে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার নীলমণিগঞ্জ গ্রামের বাড়ি থেকে কৌশলে ডেকে নিয়ে নৃশংসভাবে কুপিয়ে খুন করে দুর্বৃত্তরা। এরপর লাশ পার্শ্ববর্তী মোমিনপুর রেলস্টেশনে রেললাইনের ওপর ফেলে রেখে যায় তারা। সদরুল ছিলেন চুয়াডাঙ্গা থেকে প্রকাশিত দৈনিক মাথাভাঙ্গা পত্রিকার মোমিনপুর ইউনিয়ন প্রতিনিধি। খুনের ঘটনায় তাঁর স্ত্রী নিলুফা ইয়াসমিন (নীলিমা) ২০১৪ সালের ২২ মে পোড়াদহ রেলওয়ে থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় সদর উপজেলার বোয়ালমারী গ্রামের আবদুল মান্নানের ছেলে ক্যাপটেনকে।

১৮ জুন বিকেলে নীলমণিগঞ্জের বাড়িতে বসে কথা হয় সদরুল আলমের স্ত্রী নিলুফা ইয়াসমিনের সঙ্গে। তিনি একটি উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। পাশেই বসে ছিল কন্যা সানিয়া ও সদরুলের সহোদর শফিকুল ইসলাম। তিনি জানান, সদরুল সংবাদপত্রে লেখালেখির পাশাপাশি স্থানীয় বাজারে একটি স্টেশনারি দোকানের ব্যবসা করতেন। পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অকূলপাথারে পড়েন তিনি। উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পাওয়া সম্মানী ও কয়েক শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়িয়ে উপার্জিত অর্থে চলছে তাঁর সংসার-সংগ্রাম।

সদরুল আলম

নিলুফা বলেন, সাজানো–গোছানো সুখের সংসার ছিল তাঁদের। মধ্যবিত্ত পরিবার হলেও কোনো কিছুর কমতি রাখতেন না সদরুল। নিলুফা দাবি করেন, তাঁর স্বামীর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কারও কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। তারপরও সংঘবদ্ধ চক্রটি তাকে খুন করল। ঘাতকেরা সেদিন শুধু একটি মানুষকেই খুন করেনি, পুরো পরিবারকে খুন করেছে। এখন সংসারের খরচের পাশাপাশি মামলাসংক্রান্ত খরচের জোগান দিতে গিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত সংগ্রামের মুখোমুখি দাঁড়াতে হচ্ছে তাঁকে। তবে খুনিরা শাস্তি পেলে শান্তি পাবেন। এখন আছেন সেই দিনের অপেক্ষায়।

সাংবাদিক সদরুল যে সময়ে খুন হন, তখন একমাত্র সন্তান সানিয়ার বয়স পাঁচ বছর। বাবার কথা তুলতেই চিবুক বেয়ে পানি পড়তে থাকে। নিজেকে সামলে নিয়ে সানিয়া বলে, ‘আমার যখন যা খেতে মন চাইত, মায়ের কাছে চাইতাম। কাকতালীয়ভাবে দেখতাম, বাবা বাড়ি ফেরার সময় পছন্দের সেই খাবারগুলোই কিনে এনেছেন। বাড়িতে এসেই শুরু করতেন ঠিকমতো খেয়েছি কি না, আম্মু বকেছেন কি না। রাতে বুকে জড়িয়ে ঘুমাতেন। বাবার সেই স্পর্শ খুব মিস করি।’

সানিয়ার কথার রেশ ধরে নিলুফা বলেন, ‘মেয়ে যখন থেকে বানান করে লিখতে শিখেছে, সেদিন থেকেই বাবাকে নিয়ে ডায়েরির পাতা সাজিয়েছে। ১৮ জুন বাবা দিবসে লেখা অনুভূতি পড়ে আমি নিজেই ভাষাহীন হয়ে পড়েছি।’

সদরুল আলমের খুনিদের শাস্তি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সহোদর ভাই শফিকুল আলম। তিনি জানান, সদরুলের লাশ উদ্ধারের পর ২৫ জুন পুলিশ আমিরপুর গ্রামের আবদুল মোমিন ও মোমিনপুরের নিমাই কুমার ঘোষ নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করে। এজাহারভুক্ত আসামি ক্যাপটেন অন্য একটি অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার হলে তাঁকে এ মামলায় আদালত গ্রেপ্তার দেখান। এরপর দফায় দফায় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) পরিবর্তন শেষে পোড়াদহ রেলওয়ে থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আসফাকুর রহমান এজাহারভুক্ত ক্যাপটেনকে অভিযুক্ত করে ২০১৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। আবদুল মোমিন ও নিমাই কুমার ঘোষকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। অভিযোগপত্রের বিষয়ে বাদী আদালতে নারাজি দিলে আদালত তা গ্রহণ করেন। পুলিশ পরিদর্শক সুনীল কুমার ঘোষ মামলার তদন্তের দায়িত্ব পেলেও সরেজমিনে না গিয়ে আগের তদন্তকারী কর্মকর্তার সঙ্গে মিল রেখে অভিযোগপত্র দেন।

অথচ সাক্ষীদের বয়ানে আরও কয়েকজনের নাম এসেছিল। এরপর মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একজন পরিদর্শক তদন্ত করলেও তেমন পরিবর্তন হয়নি। যাঁর নামে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে, সেই ক্যাপটেন দীর্ঘদিন ধরেই জামিনে বাইরে আছেন।

মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। তবে অভিযুক্ত আসামি বাইরে থাকায় সাক্ষীদের মধ্যে ভীতি কাজ করছে। নতুন করে কেউ ঝামেলায় জড়াতে চাচ্ছেন না।

মামলাটি বর্তমানে চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। রাষ্ট্রপক্ষে মামলাটি পরিচালনা করছেন সহকারী সরকারি কৌঁসুলি (এপিপি) মো. গিয়াস উদ্দিন। তিনি বলেন, আলোচিত মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে।