‘শহর ধনী অইলো, আমরা গরিবই রইয়া গেলোম’
রাত দেড়টা। পৌষের কুয়াশা মোড়ানো নারায়ণগঞ্জ শহর ততক্ষণে প্রায় জনমানবহীন। পথে পথে বেওয়ারিশ কুকুরগুলোর উৎপাত। ঘরহীন মানুষেরা ধুলামাখা পাতলা কম্বল মুড়িয়ে ঘুমিয়েছেন পথের ধারে। শহরের গ্রিন্ডলেজ ব্যাংক মোড়ে তখনো কিছু মানুষ কর্মব্যস্ত। পাইকারদের কাছে বিক্রির আশায় নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা থেকে শীতকালীন শাকসবজি নিয়ে এসেছেন তাঁরা। গতকাল রোববার রাতে সেসব মানুষের ভিড়ে দেখা হলো ৭৬ বছরের বৃদ্ধ ইদ্রিস মোল্লার সঙ্গে।
প্লাস্টিকের কৌটাভর্তি টোস্ট বিস্কুট, ফ্লাক্সভর্তি চা আর সিগারেট নিয়ে ইদ্রিস মোল্লা বসে আছেন ব্যাংক ভবনের দেয়াল ঘেঁষে। ক্রেতা নেই। ফসলের মাঠ থেকে তুলে আনা তাজা শাক আর সবজিগুলোর দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। তাঁর দিকে দুই পা এগিয়ে যেতেই ক্রেতা ভেবে সতর্ক হয়ে উঠলেন। চায়ের লিকারে চুমুক দিতে দিতে কথা হলো তাঁর সঙ্গে।
মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার ফুলকুচিতে জন্ম ইদ্রিস মোল্লার। বাপ-দাদা ছিলেন অবস্থাশালী কৃষক। আট বছর বয়সে পেটের পীড়ায় বাবার মৃত্যু হয়। ভাইদের সঙ্গে তিনি নিজেও কৃষিকাজ করেছেন। ধান, আলু, তিল, তিসির চাষ করেছেন। নিজেদের জমি ছিল; ছিল নিজের ভিটেমাটি। জীবনের শুরুতে অবস্থাশালী ইদ্রিস জীবনসায়াহ্নে এসে সর্বশান্ত। কথায় কথায় জানা হলো তার দীর্ঘ জীবনের কথা।
কৈশোর পেরোনোর আগেই ইদ্রিস মোল্লা মাকে হারান; বেড়ে ওঠেন ভাইদের সঙ্গে। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ১১৩ শতাংশ জমিতে তিনি চাষাবাদ করেন। ভালোই দিন কাটে। এরই মধ্যে সংসার পাতেন। ছেলেসন্তানের আশায় পরপর তিন মেয়ের বাবা হন। আশির দশকের শুরুতে আশপাশের অনেকেই তখন ভাগ্যবদলের আশায় প্রবাসে যাচ্ছেন। প্রতিবেশী এক আদম ব্যবসায়ীর প্ররোচনায় ইদ্রিস মোল্লা ভাগ্য ফেরানোর আশায় বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করেন। নিজের ভাগের অর্ধেক ফসলি জমি বিক্রি করে প্রতিবেশী আদম ব্যবসায়ীর হাতে টাকা তুলে দেন। সেই টাকা নিয়ে পালিয়ে যায় ওই ব্যক্তি। এভাবে আরও দুবার বিদেশ যাওয়ার জন্য টাকা জোগার করতে গিয়ে নিজের ভাগের সব জমিই বিক্রি করে দেন ইদ্রিস মোল্লা। তিনবারই প্রতারণার শিকার হন। বিদেশ আর যাওয়া হয় না তাঁর।
কৈশোর পেরোনোর আগেই ইদ্রিস মোল্লা মাকে হারান; বেড়ে ওঠেন ভাইদের সঙ্গে। প্রতিবেশী এক আদম ব্যবসায়ীর প্ররোচনায় ইদ্রিস মোল্লা ভাগ্য ফেরানোর আশায় বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করেন। তবে প্রতারণার শিকার হন তিনি।
জীবনসায়াহ্নে এসে এসব কর্মকাণ্ড ইদ্রিস মোল্লার কাছে মস্ত ভুল মনে হয়। সেই ভুলের কথা বলতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। একসময়ের অবস্থাশালী কৃষক ইদ্রিস তখন বর্গাচাষি। ধারদেনা করে মানুষের জমিতে ফসল বোনেন। এরই মধ্যে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে আসে ১৯৮৮ সালের বন্যা। বন্যার পানিতে ইদ্রিসের সব ফসল তলিয়ে যায়। বন্যা শেষে দেখা দেয় চরম খাদ্যাভাব। ইদ্রিস তত দিনে তিন মেয়ে আর দুই ছেলের বাবা। সাতজনের সংসারে খাবার জোগাতে না পেরে ভাগ্যবদলের আশায় নারায়ণগঞ্জ আসেন ইদ্রিস।
ইদ্রিস বলেন, ‘শহরের কিছুই তখন চিনি না। জিমখানা বস্তির একটা খুপরি ভাড়া নিই। কাজ খুঁজি, কোথাও কাজ পাওয়া যায় না। খাইয়া না–খাইয়া দিন কাটে। বাধ্য হইয়া একসময় নিজের বাপের ভিটাটাও বেইচা দিই। এহন জানি না মরলে কবরটা কই অইব।’
পরবর্তী জীবনে কখনো ডাল মিল, কখনো রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করেছেন ইদ্রিস মোল্লা। স্ত্রী ও তিন মেয়ে বিভিন্ন কারখানায় কাজ করেছেন। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে। ছেলেরা এখন তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। তাঁদের নিয়ে নগরের দেওভোগ এলাকায় ছয় হাজার টাকা ভাড়ায় একটি বাসাতে থাকেন। দুর্মূল্যের বাজারে দুই ছেলের আয়ে সংসার চলে না। বাধ্য হয়ে সাত বছর ধরে রাতে শহরে চা বিক্রি করেন ইদ্রিস।
ইদ্রিস মোল্লা জানালেন, দিনের বেলা শহরে লোকের ভিড় থাকে। সেই ভিড়ে চায়ের ফ্লাক্স নিয়ে বসার মতো শহরে জায়গা পান না। আর হেঁটে চা বিক্রির মতো শারীরিক সামর্থ্য নেই। তাই রাতের বেলা সড়কে এসে বসেন। মুন্সিগঞ্জ থেকে লোকজন সবজি নিয়ে আসেন। তাঁদের দেখলে নিজের সোনালি দিনের কথা মনে পড়ে। প্রতিদিন রাত ১০টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত বেচাকেনা করেন। মাসে অন্তত ১০ হাজার টাকা আয় হয়।
এসব আলাপের ফাঁকে ইদ্রিস মোল্লা হিসাব করে দেখান, ২৫ বছর হয়ে গেল নারায়ণগঞ্জে এসেছেন তিনি। এই ২৫ বছরে চেনা শহর কেমন অচেনা হয়ে উঠেছে। শহরে আলো বেড়েছে, উঁচু উঁচু ভবন হয়েছে। লোকের ভিড় বেড়েছে। বেড়েছে কলকারখানাও। কিন্তু এত কিছুর ভিড়েও ইদ্রিসের ভাগ্য ফেরেনি। ইদ্রিসের ভাষায়, ‘চোখের সামনে শহর এত ধনী অইলো, আমরা গরিবই রইয়া গেলোম।’
রাত বাড়ে। পৌষের শীতল হাওয়ায় শরীর হিম হয়ে আসে। বয়সের ভারে কুঁচকে যাওয়া ত্বক আর ঘোলাটে চোখ নিয়ে পথের ধারেই বসে থাকেন বৃদ্ধ ইদ্রিস মোল্লা।