গোলপোস্টের সামনে এক পাহাড়ি প্রাচীর

পাহাড়ের মেয়ে রুপনা চাকমা বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের গোলপোস্টের নিচে প্রাচীর হয়ে আছেন
ছবি: প্রথম আলো

‘সে একা, দূর থেকে একা একা খেলা দেখার শাস্তি ভোগ করা অপরাধী।’

গোলকিপারদের সম্পর্কে এই নিষ্করুণ মন্তব্য বিখ্যাত লেখক ও সাংবাদিক এদুয়ার্দো গালিয়ানোর। 

তবে আজ যাঁর কথা বলা হবে, অপরাধী তো নয়; বরং জাতীয় দলের রক্ষাকর্তার ভূমিকা পালন করেছেন একাধিকবার। জাতিকে আনন্দ–উচ্ছ্বাসে ও গর্বে উদ্বেলিত করার মুহূর্ত বয়ে এনে দিচ্ছেন নিয়মিত। তাঁর নাম রুপনা চাকমা। পাহাড়ের মেয়ে রুপনা বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের গোলপোস্টের নিচে প্রাচীর হয়ে আছেন। বিপক্ষ দলের আক্রমণ ঠেকিয়ে দেওয়ার শেষ অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন।

আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় রুপনার দুই হাতের জাদু ও অসাধারণ নৈপুণ্য দেশকে হারের হাত থেকে বাঁচিয়েছে। গোলপোস্ট সামলাতে সামলাতে হয়ে উঠেছেন দলের আস্থার প্রতীক। এর প্রতিদানও পেয়েছেন তিনি; হয়েছেন সাফের সেরা গোলরক্ষক। একবার নয়, টানা দুবার এই স্বীকৃতি পেয়েছেন পাহাড়ের কোল থেকে উঠে আসা সংগ্রামী এই তরুণী।

প্রথমবার ২০২২ সালে। সর্বশেষ গত বছর। গত বছরের অক্টোবর নেপালকে ২–১ গোলে হারিয়ে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছিল বাংলাদেশ। দলকে চ্যাম্পিয়ন করতে গোলকিপার রুপনার ভূমিকা ছিল অনন্য। নেপালে অনুষ্ঠিত এই টুর্নামেন্টজুড়ে ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলার ফল পেয়েছেন। রুপনা টুর্নামেন্টে হজম করেছেন মাত্র চার গোল; হয়েছেন সাফের সেরা গোলকিপার।

‘অন্তত ফুটবল গরিবের সন্তান, বিশেষত কালো ও মুলাটো, যাদের একমাত্র খেলনা হচ্ছে বল, তাদের জন্য সামাজিক সোপানের কাজ করে। বল হচ্ছে একমাত্র রূপকথার দয়ালু মা, যাকে সে বিশ্বাস করতে পারে। তিনি ওদের খাওয়ান, ওদের নায়ক, এমনকি পরিণত করেন ঈশ্বরে।’

এদুয়ার্দো গালিয়ানোর এই লেখা যেন রুপনা চাকমার জীবনযুদ্ধের সঙ্গে মিলে যায়। রুপনা চাকমার ফুটবল–যাত্রায় ‘বল’ হয়ে উঠেছে দয়ালু ‘মা’, যা তাঁকে পরিণত করেছে নায়িকায় এবং এনে দিয়েছে সচ্ছলতা।

রাঙামাটির দুর্গম পাহাড়ি এক পাড়ায় জরাজীর্ণ বাড়িতে ছিল রুপনাদের পরিবারের বসবাস। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ফুটবলে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের মেয়েরা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর রুপনা চাকমার জীর্ণ ঘর নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপরই রুপনার পরিবারের জন্য নতুন ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার উদ্যোগ নেয় সরকার। পরের বছর ২০২৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রুপনা চাকমার মাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয় টিনের ছাউনি দেওয়া আধা পাকা ঘর।

রুপনাদের প্রায় জরাজীর্ণ ঘর পাকা হয়েছে। নিত্যদিনের অভাব–অনটন আজ আর নেই। বলা যায়, রুপনা ও তাঁর পরিবার অনেকটাই স্বাবলম্বী।

এই পথ পাড়ি দিয়ে আসা রুপনা চাকমার ফুটবল–যাত্রা কেমন ছিল? রুপনার মা কালাসোনা চাকমা, প্রথম কোচ বীর সেন চাকমা ও বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক চন্দ্রা দেওয়ানের সঙ্গে কথা বলে তার একটি ছবি পাওয়া যায়।

রুপনা চাকমা
ছবি: প্রথম আলো

রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার ঘিলাছড়ি ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রামে ভূঁইয়ো আাদামে রুপনাদের বাড়ি। রাঙামাটি–খাগড়াছড়ি সড়ক থেকে নেমে ভূঁইয়ো আদাম মহাসতিপটঠান ধুতাঙ্গ অরণ্য সাধনা কেন্দ্রে যাওয়ার ইটের রাস্তা। সেটি ধরে এগোলে বড়মহাপূরুম নদের সেতুটি পার হলে বাঁয়ে পাঁচ থেকে সাত মিনিট পাহাড়ি রাস্তা হেঁটে গেলে রুপনাদের বাড়ি।

পাশাপাশি পাঁচটি পরিবার সেখানে বসবাস করে। চার ভাই–বোনের মধ্যে রুপনা চাকমা সবার ছোট। রুপনা যখন মায়ের গর্ভে, তখন তাঁর বাবা মারা যান। এরপর অভাব–অনটনে দিনমজুরি করে চার সন্তানকে বড় করেছেন রুপনার মা।

স্বামীর মৃত্যুর পর তিন সন্তানকে নিয়ে অকূলপাথারে পড়েন কালাসোনা চাকমা। এর মধ্যে পৃথিবীর বুকে হাজির হয় নতুন সদস্য, রুপনা। চার সন্তান নিয়ে শুরু হয় কালাসোনার আরেক সংগ্রামের জীবন। মায়ের লড়াইয়ে সঙ্গী হন বড় দুই ভাই শান্তি জীবন চাকমা ও অটিল চাকমা। জুমচাষে খুঁজে নিয়েছিলেন জীবিকা।

সংসারের এমন দুরবস্থার ছায়া বা ছাপ থেকে অনেকটাই দূরে ছিল শিশু রুপনা। বয়স যখন একটু একটু করে বাড়ছিল, তখন থেকে ফুটবলে যেন জীবন খুঁজে পেয়েছিল। গ্রামের অন্য সব শিশু–কিশোরের সঙ্গে রুপনাও মেতে থাকত ফুটবল নিয়ে।

মেয়ের জীবন পাল্টে দেওয়া কোচ ও শিক্ষক বীর সেন চাকমার ভূমিকা আজও মনে রেখেছেন রুপনার মা কালাসোনা চাকমা। তিনি বলেন, রুপনা নানিয়ারচর ঘিলাছড়ি ইউনিয়নের হাজাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা শুরু করে। পরে শিক্ষক বীর সেন চাকমা মেয়েকে পড়াশোনার জন্য ঘাগড়া নিয়ে যান।

স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় সুযোগ পান বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টে। নিজের স্কুলের হয়ে খেলতে যান রাঙামাটি স্টেডিয়ামে। দারুণ পারফরম্যান্সে সবার নজরে আসেন। বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বীর সেন চাকমার চোখে।

বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলে পাহাড়ের যে এতগুলো মেয়ে খেলছেন, এর পেছনে বড় অবদান এই অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বীর সেন চাকমার। রুপনাকে খুঁজে বের করার নায়কও তিনি। রুপনা চাকমাকে খুঁজে পাওয়ার গল্প চলতি বছরের শুরুতে প্রথম আলোকে বলেছিলেন বীর সেন চাকমা। 

রুপনার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘কারও গাছ থেকে সুপারি পেড়ে আনতে হবে, ডাক পড়ত রুপনার। নারকেল পাড়তেও রুপনা। নানিয়ারচরের মেয়েটি যেন সারাক্ষণ গাছে গাছে ঘুরত। পাশে আমার এক আত্মীয়ের বাড়ি। তিনি আমাকে ফোন করে বললেন, মেয়েটাকে নিয়ে গিয়ে যাতে ক্যাম্পে রাখি। ফুটবলটা সে ভালো খেলে।’

‘তবে প্রথমে রুপনার পরিবার কোনোভাবেই দেবে না। প্রথমবার ফিরে আসি। কিন্তু তার খেলা মনে গেঁথে ছিল। সে ছিল অলরাউন্ডার। সব পজিশনে খেলতে পারে। পরে একটা মাইক্রো নিয়ে গিয়ে মাকে মানিয়ে রুপনাকে নিয়ে আসি।’

এভাবে পাল্টাতে শুরু করে রুপনার জীবন। বীর সেন চাকমার হাত ধরে উঠে এসে এই তরুণীর জীবন পরিবর্তনে প্রকাশ্য–নেপথ্যে ভূমিকা রাখেন আরও অনেকে। তাঁদের একজন ঘাগড়া বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক চন্দ্রা দেওয়ান।

রুপনাকে ঘাগড়ায় নিয়ে আসার পর বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়। এই বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল ঋতুপর্ণা চাকমা, মনিকা ও আনাই চিন মগিনিরা। শুরুতে থাকা–খাওয়ার টানাটানি। বীর সেন চাকমা ও শান্তিমণি চাকমার তত্ত্বাবধানে চলে তাঁদের অনুশীলন। ২০১৬ সালে জাতীয় গ্রীষ্মকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ময়মনসিংহের কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মেয়েদের হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় রুপনা, ঋতুপর্ণাদের স্কুল।

এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ঋতু, রুপনাদের। জাতীয় দলে ডাক পান রুপনা। পরবর্তী সময়ে হয়ে উঠেছেন আস্থার প্রতীক। ছাত্রীর সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন চন্দ্রা দেওয়ান। তিনি বলেন, পাহাড়ের মেয়েদের প্রতিভার অভাব নেই। প্রাথমিক বিদ্যালয়েই তাদের প্রতিভার প্রকাশ পায়। কিন্তু অনেকেই যথাযথ যত্নের অভাবে অল্প সময়ে ঝরে পড়ে। তাই এই মেয়েরা যাতে ঝরে না পড়ে, সে জন্য পাহাড়ের জেলা ও উপজেলায় ঘুরে ঘুরে খেলোয়াড় বাছাই করতেন বিদ্যালয়ের প্রতিনিধিরা। এরপর পরিবারকে বুঝিয়ে বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো। এভাবে এমন প্রক্রিয়ায় একসময় রুপনাকে চোখে পড়ে বলে জানান চন্দ্রা দেওয়ান। তিনি বলেন, তাদের যখন বিদ্যালয়ে নিয়ে আসা হয়, তখন থাকা–খাওয়ার কষ্ট ছিল। চাহিদা অনুযায়ী খাবার দিতে পারতেন না। থাকার ভালো ব্যবস্থা ছিল না।  তারপরও মেয়েরা হাল ছাড়েনি। কোচদের তত্ত্বাবধানে নিয়মিত কঠোর অনুশীলন করত রুপনা, ঋতু ও মনিকারা।

এই ছাত্রীরা কোচ আর শিক্ষকদের পরিশ্রম ও আশা বৃথা যেতে দেননি। বারবার উচ্ছ্বাসে ভাসিয়েছেন দেশ ও জাতিকে। ছাত্রীর স্বপ্নপূরণ ও সাফল্যে এখনো উচ্ছ্বসিত চন্দ্রা দেওয়ান। তিনি বলেন, ‘রুপনাদের সাফল্যের কথা ভাবতে গিয়ে কী যে আনন্দ হয়, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। রুপনা আমাদের গর্বিত করেছে, জাতিকে গর্বিত করেছে, সর্বোপরি পাহাড়ের মুখ উজ্জ্বল করেছে।  জাতির সামনে স্কুলের সুনাম এনে দিয়েছে। ওদের আলোয় আমরা এখন আলোকিত। তারা তো পরবর্তী প্রজন্মের প্রেরণা। তাদের দেখানো পথ ধরে পাহাড়ের আরও মেয়ে এখন জাতীয় পর্যায়ে খেলার স্বপ্ন দেখছে।’

ক্রীড়া সাহিত্যের এক শ্রেষ্ঠ কীর্তি বলা হয় এদুয়ার্দো গালিয়ানোর সকার ইন সান অ্যান্ড শ্যাডো নামের গ্রন্থকে। গোলকিপার প্রসঙ্গে এই বিখ্যাত লেখক বলেন, ‘গোল করে না, গোল ঠেকানোর জন্য খেলে সে। গোল ফুটবল খেলার প্রাণ, উৎসবের আগুন জ্বালিয়ে দেয় গোলদাতা। আর গোলকিপার? ঠান্ডা চাদরে নিভিয়ে দেয় সেটা।’ গোলপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে প্রহরীর ভূমিকায় থাকা রুপনা গোল ঠেকিয়ে প্রতিপক্ষের উৎসবের আগুন বারবার নিভিয়ে দিয়েছেন অসামান্য দক্ষতায়। বিপক্ষ দেশের উৎসবের আগুন নিভিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু গোলকিপার রুপনা দেশের জন্য উৎসবের আলো জ্বেলেছেন ঠিকই।