গণিতের আনন্দ-আয়োজনে মেতেছে চার অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা

জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে রাজশাহীর আঞ্চলিক গণিত উৎসবের উদ্বোধন করেন অতিথিরা। আজ সকালে শাহ মখদুম কলেজ মাঠেছবি: শহীদুল ইসলাম

শীতের সকালে কুয়াশা ভেদ করে সূর্য উঁকি দিতে শুরু করেছে মাত্র। এরই মধ্যে দিনাজপুর, রাজশাহী, যশোর ও গাজীপুরের ভিন্ন ভিন্ন ভেন্যুতে শুরু হয় শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আনাগোনা। ঠান্ডা উপেক্ষা করে একপর্যায়ে ভিড় বাড়তে শুরু করে। তাঁদের এ জমায়েত ডাচ্-বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো গণিত উৎসব-২০২৫-এর আঞ্চলিক গণিত উৎসবকে কেন্দ্র করে। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ভিড় বাড়তে থাকে। আজ শনিবার সকালে উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে এ আয়োজনে অংশ নেয় এসব অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা।

‘গণিত শেখো, স্বপ্ন দেখো’ শ্লোগানে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় ও প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনায় আঞ্চলিক গণিত উৎসবের এ আয়োজন করেছে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি। আর সহযোগিতায় আছে অঞ্চলগুলোর বন্ধুসভা।

রাজশাহীতে অংশ নেয় ৬৭১ শিক্ষার্থী

সকাল সাড়ে ৯টায় জাতীয় সংগীতের সঙ্গে জাতীয় পতাকা, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের পতাকা ও ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে রাজশাহী নগরের শাহ মখদুম কলেজে শুরু হয় উৎসব। উদ্বোধন করেন কলেজের অধ্যক্ষ এস এম রেজাউল ইসলাম। এতে রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ৬৭১ খুদে শিক্ষার্থী অংশ নেয়।

উৎসবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে হাজির হন অভিভাবকেরাও। সকাল ৯টার আগেই পুরো কলেজ প্রাঙ্গণ শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে। উৎসবে প্রথমা প্রকাশন, দ্বিমিক প্রকাশনী, তাম্রলিপি, অন্যরকম বিজ্ঞান বাক্স, তৌফিক প্রকাশন, ল্যাব বাংলা, স্বপ্ন একাত্তরের স্টলও বসে। সেসব স্টল ঘুরে বই সংগ্রহ করেন অনেকেই।

রাজশাহী নগরের কাশিয়াডাঙ্গা থেকে এসেছে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাবীদ রহমান। তার সঙ্গে ছিল বাবা আবদুল কাদের। সে বলে, ‘এবারই প্রথম অংশ নিয়েছি। আশা করি, পরীক্ষায় ভালো করব।’ অন্যদিকে তাবীদের বাবা বলেন, ‘ছেলে অংশ নিতে পেরেছে, এটাই বড় কথা।’

উদ্বোধনের পর সকাল ১০টায় ১ ঘণ্টার পরীক্ষা শুরু হয়। পরীক্ষা শেষে মঞ্চে বন্ধুসভার আয়োজনে সাংস্কৃতিক পর্বের আয়োজন করা হয়। শিক্ষার্থীদের উত্তরপত্র মূল্যায়ন চলাকালে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও বাংলাদেশ জাতীয় অলিম্পিয়াড কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ, আহ্ছানিয়া মিশন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অনুষদের ডিন অধ্যাপক ইকবাল মতিন, রুয়েটের সিইসি বিভাগের অধ্যাপক বশির আহমেদ, রাজশাহী নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজের গণিত বিভাগের অধ্যাপক সেলিনা আক্তার, রাজশাহী আহ্ছানিয়া মিশন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের প্রভাষক জোবায়ের হোসাইন ও রাজশাহী ম্যাথ ক্লাবের সভাপতি মো. মাসুদ রানা।

দিনাজপুরে উত্তরপত্র মূল্যায়ন, প্রশ্নোত্তর পর্ব

সকাল সাড়ে নয়টায় দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে শুরু হয় উৎসবের মূল আনুষ্ঠানিকতা। এ সময় জাতীয় সংগীতের সঙ্গে পতাকা উত্তোলন করা হয়। জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে আঞ্চলিক গণিত উৎসবের উদ্বোধন করেন দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ ওয়াদুদ মণ্ডল। বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের পতাকা উত্তোলন করেন ডাচ্-বাংলা ব্যাংক দিনাজপুর শাখার উপব্যবস্থাপক মোস্তফা হেলাল সুজন এবং আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের পতাকা উত্তোলন করেন দিনাজপুর জিলা স্কুলের শিক্ষক শাহজাহান সাজু। মূল অনুষ্ঠান সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন দিনাজপুর বন্ধুসভার সাবেক সভাপতি মুনিরা শাহনাজ চৌধুরী।

এ উৎসবে দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও জয়পুরহাট জেলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৬৪৮ জন শিক্ষার্থী অংশ নেয়। ঠাকুরগাঁও থেকে সপ্তম শ্রেণিতে পড়া ছেলে প্রচ্ছদ চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে উৎসবে আসেন মা ইভা চৌধুরী। তিনি বলেন, গতবার প্রাথমিক বাছাইপর্বে ছেলে সুযোগ পেয়েছিল। এবারও অংশ নিতে এসেছে। গণিতের প্রতি ছেলের আগ্রহের কারণে সকাল সাড়ে সাতটায় বাসা রওনা করেন। ছেলের আগ্রহ দেখে তাঁর নিজেরও ভালো লাগছে বলে জানান।

কনকনে ঠান্ডা উপেক্ষা করে উৎসবে অংশ নেয় দিনাজপুর অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা। আজ সকালে দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট মাঠে
ছবি: মঈনুল ইসলাম

শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানিয়ে উদ্বোধনী পর্বে অধ্যক্ষ ওয়াদুদ মণ্ডল বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের ছেলেমেয়েরা সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতির সঙ্গে আছে। যেখানে মুখস্থ বিদ্যাকে দূরে ঠেলে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মধ্যে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাঁদের মেধার বিকাশ ও সামাজিক উন্নয়নে গণিত অলিম্পিয়াডের এ আয়োজন একটি সৃজনশীল প্ল্যাটফর্ম। এতে অর্জিত জ্ঞান ও মেধাকে সব শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অগ্রগতি নিশ্চিত করা যাবে।’

শিক্ষার উন্নয়নে গণিত অলিম্পিয়াডের মতো বিভিন্ন ধরনের কাজে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক পাশে থাকে বলে জানান ব্যাংকটির দিনাজপুর শাখার উপব্যবস্থাপক মোস্তফা হেলাল সুজন। তিনি বলেন, এই উৎসবে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আগ্রহ ক্রমেই বাড়ছে। শিক্ষার্থীরা গণিত ভীতিকে দূরে ঠেলে আজ বিষয়টিকে আনন্দপাঠে পরিণত করেছে।

সকাল ১০টায় দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন কক্ষে পরীক্ষা শুরু হয়। পরীক্ষার পর বন্ধুসভার সদস্যদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। একদিকে চলে শিক্ষার্থীদের উত্তরপত্র মূল্যায়ন, অন্যদিকে অনুষ্ঠিত হয় শিক্ষার্থীদের প্রশ্নোত্তর পর্ব। গণিত নিয়ে শিক্ষার্থীদের নানা প্রশ্নের উত্তর দেন দিনাজপুর হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষক মামুনুর রশিদ, দিনাজপুর সরকারি কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আবদুস সালাম প্রমুখ।

শীতের সকালে নরম রোদ মেখে ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক–প্রথম আলো গণিত উৎসব শুরু হয়। জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। আজ সকালে যশোর জিলা স্কুলে
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

‘গণিতে মাত্র ৭ নম্বর পেয়েছিলাম’

সকাল সোয়া নয়টার দিকে যশোর জিলা স্কুলে মাঠে এ আঞ্চলিক গণিত উৎসবের উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক মো. আজাহারুল ইসলাম। এ সময় মধুসূদন তারাপ্রসন্ন বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীদের জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে জাতীয়, আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড ও বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের পতাকা উত্তোলন করা হয়।

উদ্বোধনী বক্তব্যে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘আমি ষষ্ঠ শ্রেণিতে গণিতে মাত্র ৭ নম্বর পেয়েছিলাম। আমার মতো গণিতে খারাপ শিক্ষার্থী এখানে আর একজনও নেই। গণিতে আমার ভীষণ ভয় ছিল। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, আমাকেই সেই গণিত উৎসবের উদ্বোধন করতে হচ্ছে। ৩৫ বছর আগে এ ধরনের উৎসবে আমি যোগ দিতে পারলে হয়তো গণিতে আমার ভয় থাকত না। সেই হিসেবে তোমরা সৌভাগ্যবান। রাতারাতি গণিতের জ্ঞান অর্জন করার বিষয় নয়, এটা দীর্ঘ চর্চার বিষয়।’

উদ্বোধনের পর ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিটের পরীক্ষা শুরু হয়। মাগুরা থেকে দুই ছেলে–মেয়ে নিয়ে উৎসবে যোগ দেন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক রুবিনা জেসমিন। তিনি বলেন, গণিত নিয়ে ছেলেমেয়েদের অনেক আগ্রহ। এ জন্য তাদের নিয়ে ম্যাথ ও ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের মতো উৎসবে যোগ দিতে হয়।

গাজীপুরে বন্ধুসভার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান

গাজীপুরের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উচ্চবিদ্যালয় মাঠে আজ সকাল ১০টার দিকে সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য শুরু হয় গণিত উৎসব। এ সময় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক অধ্যাপক অসীম বিভাকর, আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের পতাকা উত্তোলন করেন বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির কোষাধ্যক্ষ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন ও ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের পতাকা উত্তোলন করেন জয়দেবপুর শাখার ব্যবস্থাপক (পাবলিক রিলেশন) মোহাম্মদ শাহিন আলম।

অনলাইনে প্রাথমিক বাছাইপর্বে নির্বাচিত ৪৮০ জন শিক্ষার্থী এ উৎসবে যোগ দেয়। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর সকাল ১০টা ২০ মিনিটে বিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবনের ছয়টি কক্ষে তাঁদের গণিতের পরীক্ষা শুরু হয়। পরীক্ষার পর বিদ্যালয়ের মিলনায়তনে বন্ধুসভার সদস্যদের পরিবেশনায় আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। এরপর চলে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্নোত্তরের পর্ব।

গণিত উৎসবে বইয়ের স্টলে ভিড় জমায় প্রতিযোগী শিক্ষার্থীরা। আজ সকালে গাজীপুরের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উচ্চবিদ্যালয়ে
ছবি: মাসুদ রানা

গণিত উৎসবে অংশ নিয়ে উচ্ছ্বসিত ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী অনির্বাণ ভৌমিক। অনুভূতি জানতে চাইলে সে বলে, ‘গণিতের প্রতি আমার বেশি আগ্রহ। তাই তিন বছর ধরে আমি এ পরীক্ষায় অংশ নিই। আমার সঙ্গে মা–বাবাও এসেছেন। তাঁরাও চান, আমি যেন অঙ্কে ভালো করি।’

গণিত উৎসবকে কেন্দ্র করে স্কুল মাঠে বসে প্রথমা প্রকাশনীর স্টল। সেখানে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভিড় দেখা গেছে। অনেকে নিজের পছন্দের বইও কিনছেন।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অধ্যাপক অসীম বিভাকর বলেন, প্রকৃতিও একটি গাণিতিক নিয়ম অনুসরণ করে চলে। যেমন ভূভাগের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা উচিত, কিন্তু সেই বনভূমিকে আমরা নামিয়ে এখন ৪ শতাংশে নিয়ে এসেছি। ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ফলে কার্বন ডাই-অক্সাইড যে পরিমাণে উৎপন্ন হচ্ছে, সেটি গ্রহণ করতে পারছে না। প্রকৃতির গণিতকে যদি আমরা অনুসরণ করতাম, তাহলে আজ এই বিপর্যয় হতো না। তাই জীবনের সব ক্ষেত্রে গাণিতিক নিয়মকে মেনে চলতে হবে।

(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন শফিকুল ইসলাম, রাজশাহী, রাজিউল ইসলাম, দিনাজপুর, মাসুদ রানা, গাজীপুরমনিরুল ইসলাম, যশোর)