‘সাত দিন থাকি পানিত আচি, একনো কোনো ইলিপ পানো না’
চারপাশে অথৈ পানি। রান্নাঘরে হাঁটুপানি। ঘরের মেঝেও ডুবে গেছে। তাই থাকার ঘরে একটা কাঠের টেবিলে চুলা বসিয়ে রান্না করছেন গৃহিণী আয়শা বেগম (২৫)। পাশে একটি চৌকিতে দুই শিশুসন্তান আশিক মিয়া (৭) এবং আরমান মিয়া (১১ মাস) বসে রান্না শেষ হওয়ার অপেক্ষায়।
গতকাল শনিবার বিকেলে তিস্তা নদীবেষ্টিত গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার কাপাসিয়া ইউনিয়নের পোড়াচর গ্রামের দিনমজুর মনিরুল ইসলামের বাড়িতে গিয়ে এমন চিত্র দেখা যায়। আয়শা বেগম দিনমজুর মনিরুল ইসলাম স্ত্রী। মনিরুল ইসলাম চরে ঘোড়ার গাড়ি চালান।
আয়শা বেগম বলেন, ‘বাড়িত পানি। ঘোড়া থোয়ার জাগা নাই। হামার স্বামী ঘোড়া নিয়া উঁচা জাগাত আচে। ছোল দুইটে যদি পানিত পড়ি যায়, তাই টেবিলোত আন্নাবান্না আর চৌকিত ঘুমব্যার নাগচি। হামার স্বামী চরে ঘোড়ার গাড়ি চালাত। বানের জন্নে গাড়ি চালানো বনদো আচে। ধারদেনা করি চলব্যার নাগচি। এ কয় দিনে দুই হাজার ট্যাকা দেনা হচে। সাত দিন থাকি পানিত আচি, একনো কোনো ইলিপ পানো না।’
মনিরুল ইসলাম বলেন, শুকনা মৌসুমে ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে দৈনিক ৪০০-৫০০ টাকা উপার্জন হতো। এখন বন্যার কারণে রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। গাড়ি চালিয়ে উপার্জন করা দূরের কথা, ঘোড়ার খাবার জোগার করাই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। বাড়িতে পানি ওঠায় ঘোড়া রাখার জায়গা নেই। তাই অন্য গ্রামের উঁচু জায়গায় ঘোড়া রেখেছি। সেখানে রাতদিন ঘোড়া পাহারা দিচ্ছি। এখনো ত্রাণ পাইনি।
গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে কামারজানি বাজার। সেখান থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকাযোগে প্রায় এক ঘণ্টার পথ। তারপর কাপাসিয়া ইউনিয়নের পোড়ারচর গ্রাম। পোড়ারচরসহ ইউনিয়নটি তিস্তা নদীর কারণে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। পুরো ইউনিয়ন এখন পানিতে নিমজ্জিত।
পোড়ারচর গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, বন্যায় ডুবে আছে ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট। উঠোনে ছোট ছেলেমেয়েরা নৌকায় অবস্থান করছে। অনেকে কলাগাছের ভেলা চালাচ্ছে। ইউনিয়নের সবাই আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারেননি। অনেক লোকজন বাড়িতেই আছেন। মাচা করে ও চৌকিতে হাঁস, মুরগি রেখেছেন। অন্য গ্রামের উঁচু জায়গায় গরু-ছাগল রেখেছেন।
পোড়ারচর গ্রামের কৃষক নছির উদ্দিন (৫৫) বলেন, ‘বান আসি হামরা পানির সাতে যুদ্ধ করব্যার নাগচি। গরু–বাচুর ছাড়ি উঁচা জাগাত যাই নাই। আট দিন থাকি কসটো করি পানির মদ্দে আচি। যেকনা চাউল আচিলো, তাক শ্যাষ হচে। কোনো ইলিপ (ত্রাণ) পানো না’।
ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য রেজাউল করিম বলেন, নদীর পানি কিছুটা কমলেও চরাঞ্চল থেকে পানি নামতে সময় লাগবে। বাড়িঘর ডুবে যাওয়ায় মানুষ খুব কষ্টে আছে। বন্যার কারণে তারা ভোগান্তির মধ্যে আছে। আজ রোববার দুপুর পর্যন্ত এসব এলাকায় কোনো ত্রাণ পৌঁছেনি।
কাপাসিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মনজু মিয়া মুঠোফোনে বলেন, ‘গোটা ইউনিয়নে প্রায় ৪২ হাজার মানুষের বসবাস। এর মধ্যে প্রায় ৩২ হাজার মানুষই অভাবী। বেশির ভাগ মানুষ এখন পানিবন্দী। এ পর্যন্ত ইউনিয়নে আড়াই মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পেয়েছি। কিন্তু ইউনিয়নের লোকসংখ্যা অনুপাতে ত্রাণ বরাদ্দ পাইনি। অর্থাৎ যে পরিমাণ ত্রাণ দরকার, তা পাইনি।’
সুন্দরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তরিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বন্যায় যেসব ইউনিয়ন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, সেগুলোয় বেশি ত্রাণ দেওয়া হবে। পোড়ারচর গ্রামেও ত্রাণ পৌঁছানোর বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে।