মাঠ রক্ষায় আন্দোলন করতে গিয়ে মানুষ রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হয়রানির শিকার হচ্ছে: সুলতানা কামাল

বলাইশিমুল মাঠ রক্ষা গণকমিটি আয়োজিত সমাবেশে কথা বলেন সুলতানা কামাল। শুক্রবার কেন্দুয়া উপজেলার বলাইশিমুল এলাকায় ঈদগাহ ময়দানে
ছবি: প্রথম আলো

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, বলাইশিমুল মাঠ রক্ষায় শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে গিয়ে সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হয়রানির শিকার হচ্ছে। আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তাদের আন্দোলন জাতীয় সম্পদ বাঁচানোর আন্দোলন। কিন্তু এই হয়রানি অত্যন্ত লজ্জাজনক। শুক্রবার বিকেলে নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার বলাইশিমুল খেলার মাঠে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণের প্রতিবাদে আয়োজিত সমাবেশে এসব কথা বলেন তিনি।

বলাইশিমুল এলাকায় ঈদগাহ ময়দানে বলাইশিমুল মাঠ রক্ষা গণকমিটি সমাবেশটির আয়োজন করে।

মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, ‘প্রতিনিয়ত আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সম্পদ রক্ষার কথা বলছেন। কোনো জলাশয়, খেলার মাঠ নষ্ট না করার কথা বলছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ না মেনে কেন বলাইশিমুল শত বছরে ঐতিহ্যবাহী খেলার মাঠে ঘর করে নষ্ট করা হচ্ছে। মনে হয় যিনি স্থানীয়ভাবে প্রশাসন চালাচ্ছেন, তাঁর বুদ্ধিতে প্রধানমন্ত্রীর এসব কথা কোলাচ্ছে না। যাঁরা মাঠ নষ্ট করে ঘর বানালেন, তাঁদের প্রতি নিন্দা জানানোর ভাষা নেই।’

বলাইশিমুল মাঠ রক্ষা গণকমিটির আহ্বায়ক আবুল কালাম আল আজাদের পরিচালনায় সমাবেশে বক্তব্য দেন নিজেরা করির নির্বাহী খুশী কবির, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, উদীচীর কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আরিফ নূর, রাজধানীর তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক সৈয়দা রত্না, বলাইশিমুল ইউনিয়ন পরিষদের ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা সদস্য কলি আক্তার প্রমুখ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কৃষক হাবিবুর রহমান মণ্ডল।

সমাবেশে খুশী কবির বলেন, মাঠ রক্ষায় যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, তা প্রত্যাহার করতে হবে। আর যেন নতুন করে কোনো মামলা না দেওয়া হয়, আর যেন কাউকে হয়রানি না করা হয়। দাবি না মানা পর্যন্ত মাঠ রক্ষায় অহিংস নীতিতে যত ধরনের আন্দোলন আছে, তা করা হবে।

স্থানীয় বাসিন্দা ও ইউএনওর কার্যালয় ও থানা-পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বলাইশিমুল গ্রামের ১ একর ৮৭ শতক সরকারি জায়গায় শত বছরের পুরোনো খেলার মাঠ আছে। সেখানে শিশু-কিশোর, শিক্ষার্থীসহ তরুণ-যুবকেরা খেলাধুলা করেন। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে আশ্রয়ণ প্রকল্প-২-এর আওতায় ওই মাঠের চারপাশে প্রশাসন ভূমি ও গৃহহীনদের জন্য ১০০টি ঘর নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। স্থানীয় বাসিন্দারা এ কাজে বাধা দেন। তাঁরা ওই জায়গার পরিবর্তে অন্য জায়গায় ঘর নির্মাণের দাবি জানান। কিন্তু প্রশাসন সিদ্ধান্তে অটল থেকে ঘরের সংখ্যা কমিয়ে ২৩টি ঘর নির্মাণকাজ চালায়। এর জন্য মাঠের ৪৬ শতক জায়গা ‘কান্দা’ শ্রেণিতে পরিবর্তন করে। স্থানীয় ব্যক্তিদের বাধা উপেক্ষা করে ২৮ মে থেকে মাঠের দক্ষিণ ও পশ্চিম পাশে ঘর নির্মাণকাজ শুরু হয়। মাঠ রক্ষায় স্থানীয় লোকজন কমিটি গঠন করে দেশের বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিলসহ প্রতিবাদ জানান।

এ ঘটনায় স্থানীয় বাসিন্দা ও কৃষক হাবিবুর রহমান মণ্ডলসহ আটজন বাদী হয়ে গত ৩০ মে আদালতে একটি মামলা করেন। গত ২ জুন রাতের আঁধারে দুটি নির্মাণাধীন ঘরের গাঁথুনি ভেঙে দেয় দুর্বৃত্তরা। পরদিন প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী বাদী হয়ে ১৯ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন। মামলায় বলাইশিমুল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান আলী আকবর তালুকদার, ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য হায়দার আলী তালুকদারকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর সার্বক্ষণিক পুলিশি পাহারায় ঘর নির্মাণকাজ চলে।

স্থানীয় ব্যক্তিদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সেখান থেকে ১১টি ঘর বাদ দেন। একই সঙ্গে মাঠে মাটি ফেলে খেলার উপযোগী করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। মাঠের পশ্চিম পাশে ২৪ শতক জায়গায় ১২টি ঘর নির্মাণ করা হয়। কিন্তু ১২ আগস্ট ভোরে দুটি ঘরে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। পরদিন ৬৩ জনের নাম উল্লেখ করে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা বাদী হয়ে মামলা করেন।

ঘরে আগুন দেওয়ার ঘটনার ইউএনও মাহমুদা বেগম উপজেলা পরিষদের সম্মেলনকক্ষে সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে তিনি আগুন দেওয়ার ঘটনার পেছনে আওয়ামী লীগের সাবেক স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ কয়েকজন নেতাকে দোষারোপ করেন। এনএসআই, ডিজিএফআইয়ের গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে তিনি এসব তথ্য জেনেছেন বলে উল্লেখ করেন। একই সঙ্গে ইউএনও পুরো বলাইশিমুল ইউনিয়নের সবার বিরুদ্ধে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলা করার হুঁশিয়ারি দেন। ইউএনওর সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য দৈনিক সংবাদ ও ডেইলি অবজারভার-এর কেন্দুয়া উপজেলা প্রতিনিধি হুমায়ূন কবীর তাঁর নিজের ফেসবুকে পোস্ট করেন। এতে ইউএনও ক্ষুব্ধ হয়ে হুমায়ূন কবীরকে মামলায় জড়ানোর হুমকি দেন। পরে ইউএনওকে জেলা প্রশাসক কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন।

গত ১৯ আগস্ট বলাইশিমুল ঈদগাহে ইউনিয়নের ২৮ গ্রামের বাসিন্দাদের গণবৈঠকে ইউএনও মাহমুদা বেগমকে বলাইশিমুল ইউনিয়নে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে তাঁকে অপসরণের আলটিমেটাম দেওয়া হয়। ২৪ আগস্ট ইউএনওকে মদনে বদলি করা হয়। পরে এক দিনের ব্যবধানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে তাঁকে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের পদায়ন করা হয়।

এদিকে মাঠে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) রিটটি করে। ১৪ আগস্ট আদালত ঘর নির্মাণে দুই মাসের স্থগিতাদেশ দেন।

আরও পড়ুন