বাগেরহাটে বিএনপির মনোনয়ন পেলেন আওয়ামী লীগের সাবেক ২ নেতা, তৃণমূলে ক্ষোভ

বিএনপির মনোনয়ন পাওয়া কপিল কৃষ্ণ মণ্ডল ও সোমনাথ দে (ডানে)
ছবি: সংগৃহীত

বাগেরহাটের চারটি আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে বিএনপি। চার প্রার্থীর মধ্যে দুজনই আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা। এ নিয়ে বিএনপির স্থানীয় নেতা-কর্মীদের অনেকেই অসন্তুষ্ট। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে চায়ের দোকান—সবখানেই বিষয়টি নিয়ে চলছে আলোচনা ও সমালোচনা।

বিএনপির ওই প্রার্থীরা হলেন বাগেরহাট-১ (ফকিরহাট-মোল্লাহাট-চিতলমারী) আসনে কপিল কৃষ্ণ মণ্ডল ও বাগেরহাট-৪ (শরণখোলা-মোরেলগঞ্জ) আসনে সোমনাথ দে। তাঁরা দুজনই আগে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

বাগেরহাট-১ আসনে মনোনয়ন পাওয়া কপিল কৃষ্ণ মণ্ডল মতুয়া বহুজন সমাজ ঐক্যজোটের সাধারণ সম্পাদক। একই সঙ্গে তিনি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের মহাসচিব এবং বাংলাদেশ অশ্বিনী সেবা আশ্রমের সভাপতি। তিনি চিতলমারী উপজেলার কলাতলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ছিলেন বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একাধিক নেতা জানিয়েছেন। তবে কপিল কৃষ্ণ মণ্ডল বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।

অন্যদিকে বাগেরহাট-৪ আসনে মনোনয়ন পাওয়া সোমনাথ দে মতুয়া বহুজন সমাজ ঐক্যজোটের সভাপতি। তিনি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সভাপতি ছিলেন। মোরেলগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে তিনি জাতীয় পার্টির রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। বাগেরহাট-৪ থেকে জাতীয় পার্টির হয়ে নির্বাচনও করেছেন। ছিলেন প্রয়াত হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সংখ্যালঘুবিষয়ক উপদেষ্টা।

কপিল কৃষ্ণকে চলতি বছরের মার্চে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অপর একটি মামলায় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন সোমনাথ দে। পরে তাঁরা জামিনে মুক্ত হন। এরপর চলতি বছরের ২০ আগস্ট সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁরা বিএনপিতে যোগ দেন।

আওয়ামী লীগের সাবেক দুই নেতার মনোনয়ন নিয়ে নেতা-কর্মীদের অনেকে সমালোচনা করছেন। মোল্লা রাজু আহমেদ নামের চিতলমারীর এক বিএনপি কর্মী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘...নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে, যতটা অসহায় বিগত ফ্যাসিস্ট আমলেও মনে হয়নি। আমাদের এ নির্বাচনী আসনে অনেক প্রবীণ-তরুণ যোগ্য ত্যাগী নেতৃত্ব রয়েছে। যাঁরা শেখ হাসিনা, শেখ হেলালের বিরুদ্ধে নির্বাচনে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, তাঁদের মধ্য থেকে যেকোনো একজনকে নমিনি (মনোনয়ন) করলে এ আসনের মানুষ বিপুল ভোটে ধানের শীষকে নির্বাচিত করত। কিন্তু এই নমিনেশনের খবরটি শোনার পর থেকে নিজেকে আর নিতে পারছি না।’

অনেকেই ওই দুই প্রার্থীকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আওয়ামী লীগের দালাল হিসেবে আখ্যা দিয়ে পোস্ট করছেন। শিমুল হোসেন নামের এক বিএনপির সমর্থক বলেছেন, ‘সারা বছর রাজপথে থেকে ১৭ বছর ঘুমাতে পারিনি। এখন উড়ে এসে জুড়ে বসেছে।’

এ বিষয়ে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক এ টি এম আকরাম হোসেন (তালিম) বলেন, ‘কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের বাইরে আমাদের আসলে করার কিছু নেই। তবে স্থানীয় নেতা-কর্মীদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। দীর্ঘদিন দল করে, জুলুম-নির্যাতন সহ্য করার পর অন্য দলের কেউ এসে মনোনয়ন পাওয়ায় তারা ক্ষোভে ফুঁসছে। আমরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে এসব বিষয় কেন্দ্রকে জানিয়েছি।’

জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এম এ সালাম বলেন, ‘আওয়ামী লীগের পদধারী নেতাদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা এটি কীভাবে মেনে নেবে বলেন? তাঁরা দুজনই সুবিধাবাদী এবং শেখ হেলালের নিকটতম অনুসারী ছিলেন। সনাতন ধর্মের যদি কাউকে দিতেও হয়, দলে ভালো যে হিন্দু ভাইয়েরা রয়েছে, তাদের থেকে দিত। নেতা-কর্মীরা সত্যিই হতাশ হয়েছে।’

জানতে চাইলে কপিল কৃষ্ণ মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘কখনো অন্য কোনো দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। এটিই আমার প্রথম রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া। দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ মন্দিরের সভাপতি হওয়ায় নির্যাতিত হিন্দুদের অধিকার আদায়ে আমি সব সময় সোচ্চার ছিলাম। এ কারণে এমপি-মন্ত্রীদের সঙ্গে আমার কথা বলতে হয়েছে। সেসব ছবি দেখিয়ে এখন ষড়যন্ত্র চলছে। কেউ বলতে পারবে না, কোনো রাজনৈতিক মঞ্চে আমি বক্তব্য দিয়েছি।’ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কমিটির কাগজ ভিত্তিহীন দাবি করে তিনি বলেন, ‘পদ নিতে চাইলে অনেক বড় পদ আমি পেতাম, ইউনিয়ন কমিটিতে কেন যাব? আর মামলার বিষয়টিও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। উচ্চ আদালত থেকে গত সপ্তাহে রুল নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।’

সোমনাথ দে বলেন, ‘আমি মনোনয়ন পাওয়ায় যারা চাঁদাবাজ, জুলুমকারী, নির্যাতন করে, তাদের গাত্রদাহ হচ্ছে। কিন্তু যাঁরা সাধারণ মানুষ, তাঁরা আমাকে সাদরে বরণ করেছেন। আমি জাতীয় পার্টি করেছি, আওয়ামী লীগ করেছি, ৫ আগস্টের পর জেল খেটেছি। আমার নামে এখনো তিনটি মামলা রয়েছে। এসব জেনেই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মহোদয়, দলের হাইকমান্ড আমাকে মনোনীত করেছেন।’

এদিকে বাগেরহাটে-২ (সদর ও কচুয়া) আসনে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য শেখ মোহাম্মদ জাকির হোসেন ও বাগেরহাট-৩ (মোংলা-রামপাল) আসনে জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক শেখ ফরিদুল ইসলামকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।

বাগেরহাট-২ আসনে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে বিএনপির একাংশের মশালমিছিল। রোববার সন্ধ্যায় শহরের শহীদ মিনার সড়কে
ছবি: প্রথম আলো

প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে মশালমিছিল

বাগেরহাট-২ আসনে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে আজ সন্ধ্যা সাতটায় শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ থেকে মশালমিছিল বের করেন স্থানীয় বিএনপির একটি পক্ষ। এতে বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল ও শ্রমিক দলের একাংশের নেতা-কর্মীরা অংশ নেন।

মিছিলকারীরা জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এম এ সালামকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানান। বিক্ষোভকারীরা তাঁকে মনোনয়ন না দিলে তাঁরা ভোটকেন্দ্রে যাবেন না বলেও স্লোগান দেন।