যে জনপদের নাম রাজকন্যার নামে

অভয়ানগরে ভৈরব নদের তীরে রাজা নীলকণ্ঠ রায়ের (১৭৪৫-১৭৬৪) আমলে নির্মিত শিবমন্দির
ছবি: প্রথম আলো

রাজকন্যার নাম ছিল অভয়া। তাঁর নামে গ্রামের নাম হয়েছিল অভয়ানগর। যুগ যুগ ধরে মানুষের মুখে মুখে ফিরতে ফিরতে অভয়ানগর গ্রাম হয়ে গেছে অভয়নগর। গ্রামটির অবস্থান যশোরের অভয়নগর উপজেলার ভৈরব নদের পাড়ে। এই গ্রামের নাম অনুসারে উপজেলাটিরও একই নাম হয়েছে।

একসময় যশোর এলাকাটি ইমাদপুর পরগনার অন্তর্ভুক্ত ছিল। যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের পরে চাঁচড়ায় জমিদারদের প্রভাব বেড়ে যায়। পরে তাঁরা রাজা উপাধি লাভ করেন। ওই সময়কার রাজা কন্দর্প রায় (১৬১৯-১৬৫৮) ইমাদপুর পরগনার চাঁচড়া গ্রামে রাজবাড়ি নির্মাণ করেন। তাঁর পর চাঁচড়ার রাজা হন তাঁর ছেলে মনোহর রায়। তাঁর শাসনামল ছিল ১৬৫৮ থেকে ১৭০৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। মনোহর রায়ের তিন ছেলে ও এক মেয়ে ছিল। রাজকন্যার নাম অভয়া।

বিভিন্ন বই ও পত্রপত্রিকার সূত্রে জানা যায়, উপজেলার নাম নিয়ে একটি জনশ্রুতি আছে। ওই জনশ্রুতি অনুযায়ী, অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন অভয়া। রাজা তাঁর পড়াশোনার পাশাপশি শাস্ত্র বিষয়ে জ্ঞানার্জনের ওপর গুরুত্ব দেন। অভয়াকে শাস্ত্র বিষয়ে শিক্ষা দিতেন পণ্ডিত সুখলাল চক্রবর্ত্তী। তিনি যুবক বয়সেই পণ্ডিত হয়েছিলেন। এক রাতে অভয়া স্বপ্নে দেখলেন, রাজবাড়িতে বিরাট আয়োজন। চারদিকে আনন্দ–উল্লাস। সানাই বাজছে। পণ্ডিত সুখলাল চক্রবর্ত্তীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হচ্ছে।

এ ঘটনার পর কেটে যায় অনেক দিন। পণ্ডিত সুখলাল চক্রবর্ত্তীর সঙ্গে অভয়ার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরপর একদিন দুপুরে অভয়া তাঁর বাবা রাজা মনোহর রায়কে নিজের স্বপ্নের কথা খুলে বলেন। রাজা তাঁর মতামত জানতে চান। কিন্তু অভয়া হ্যাঁ-না কিছুই বলেন না। রাজা বুঝতে পারেন, এই বিয়েতে অভয়ার অমত নেই। পরের দিন রাজা তাঁর স্বজনদের নিয়ে দরবারে বসেন এবং পণ্ডিত সুখলাল চক্রবর্ত্তীর সঙ্গে অভয়ার বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন বলে জানান। এ কথা শুনে স্বজনেরা খেপে যান। অনেকে দরবার ত্যাগ করে চলে যান। কিন্তু রাজা তাঁর মতে অটল থাকেন। তিনি বিয়ের ঘোষণা দেন।

১১টি শিবমন্দিরে বড় শিবমন্দিরটি
ছবি: প্রথম আলো

মহা ধুমধামে বিয়ে হয়। জামাই হিসেবে পণ্ডিত সুখলাল চক্রবর্ত্তীর ঠাঁই হয় রাজবাড়িতে। এ বিয়েতে রানিও রাজি ছিলেন না। বিয়ের পর রানি রাজার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেন। রাজা মনোহর রায়ের স্বজনেরাও দুঃখ পান। অনেকে রাজবাড়িতে যাতায়াত বন্ধ করে দেন। এ খবর জানতে পেরে পণ্ডিত সুখলাল চক্রবর্ত্তী রাজবাড়ি ছেড়ে যশোরের নওয়াপাড়ার কাছে ভৈরব নদের তীরে এক মন্দিরে আশ্রয় নেন। রাজবাড়িতে অভয়ার দিন কাটে বিরহ–বেদনায়। রাজা মেয়ের এত কষ্ট দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েন।

নওয়াপাড়া এলাকায় রাজা মনোহর রায়ের অনেক জমি ছিল। এর বড় এটা অংশ অভয়ার নামে লিখে দিয়ে রাজা সেখানে রাজবাড়ি নির্মাণের আদেশ দেন। কিছুদিনের মধ্যে রাজবাড়ির নির্মাণকাজ শেষ হয়। চাঁচড়া থেকে নদীপথে রাজবাড়িতে এসে ওঠেন অভয়া। কাছে পান স্বামী সুখলাল চক্রবর্ত্তীকে। এরপর কেটে যায় কয়েক বছর। কিন্তু সুখ বেশি দিন টেকে না অভয়ার। একদিনের জ্বরে মারা যান স্বামী সুখলাল। কেঁদে বুক ভাসান অভয়া। তবে চাঁচড়া রাজবাড়িতে আর ফেরেন না। অভয়া নিজেকে নিয়োজিত করেন ধর্ম ও সমাজসেবার কাজে। তাঁর বাড়িকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলেন একটি শহর। লোকে অভয়ার নাম অনুসারে এই শহরের নাম রাখেন অভয়ানগর।

ইতিহাসবিদ সতীশচন্দ্র মিত্রের যশোহর-খুলনার ইতিহাস বইয়ের (১৯১৪ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত) দ্বিতীয় খণ্ডে ‘চাঁচড়া রাজবংশ’ অধ্যায়ে অভয়ানগরের উল্লেখ রয়েছে। ওই বর্ণনা অনুযায়ী, স্থানটি অভয়া নামের বিধবা রাজকন্যার সম্পত্তিভুক্ত করে দেওয়া হয় বলে এর নাম অভয়ানগর। পরে চাঁচড়ার রাজা নীলকণ্ঠ রায় (১৭৪৫-১৭৬৪) অভয়ানগরে ভৈরব নদের তীরে রাজবাটি এবং ১১টি শিবমন্দির গড়ে তোলেন। রাজবাটি ও শিবমন্দিরগুলো ছিল পরিখাবেষ্টিত। একদিকে ভৈরব নদ এবং অন্য তিন দিকে গড়খাই। রাজবাড়ি এখন আর নেই, কিন্তু ১১টি মন্দির আছে। পূর্ব-পশ্চিমে প্রত্যেক দিকে প্রতি সারিতে চারটি করে মোট আটটি ও সদর তোরণের দুই পাশে দুটি—এভাবে মোট ১১টি মন্দির। নাম একাদশ শিবমন্দির। মন্দিরগুলো বেশ দৃঢ় এবং বড় মন্দিরটি দেখতে বেশ সুন্দর।

সেই চাঁচড়ার রাজারা বা রাজকন্যা অভয়া গত হয়েছেন কয়েক শতাব্দী আগে। কিন্তু যশোর জেলার একটি গ্রাম ও একটি উপজেলা রাজকন্যা অভয়ার স্মৃতি ধরে রেখেছে। অভয়নগর গ্রামের ৮৮ বছর বয়সী প্রবীণ মাধব চন্দ্র বর্মণ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি চাঁচড়া জমিদার বংশের রাজকন্যা অভয়ার নামে অভয়নগর। এখানে এখনো এক আঙিনায় ১১টি মন্দির রয়েছে। মন্দিরগুলো আমাদের ঐতিহ্য। একসময় গ্রামের প্রাণকেন্দ্র ছিল মন্দির প্রাঙ্গণ। মাঝে মন্দিরগুলো জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছিল। সংস্কার করায় বর্তমানে কিছুটা প্রাণ ফিরে পেয়েছে।’