কুমিল্লার তিতাসে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এখন জামায়াতের নেতা
কুমিল্লার তিতাস উপজেলার মজিদপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. আবু হানিফ। দীর্ঘদিন ধরে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এলাকাবাসীও চিনতেন আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে। বিতর্কিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও নৌকার প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জানা গেল, তিনি একই ওয়ার্ড জামায়াতে ইসলামীর সভাপতি।
আওয়ামী লীগের সক্রিয় নেতা ওয়ার্ড জামায়াতের সভাপতি হওয়ায় আবু হানিফকে নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।
তবে হানিফের ভাষ্য, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের চাপে এলাকাবাসীর উন্নয়নের জন্য তিনি ‘মৌখিকভাবে’ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের পদে থাকলেও তিনি মনেপ্রাণে জামায়াতের রাজনীতি করেছেন।
তিতাস উপজেলা ও কুমিল্লা উত্তর জেলা জামায়াতের নেতারাও বলছেন, ইউপি চেয়ারম্যানের চাপে কৌশলগত কারণে আবু হানিফ আওয়ামী লীগের পদ নিলেও তিনি দীর্ঘদিন জামায়াতের রাজনীতি করেন।
তবে ইউপি চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আলমের দাবি, ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নিজের ভোল পাল্টেছেন আবু হানিফ। তিনি তদবির করে আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড সাধারণ সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নিয়েছিলেন।
আবু হানিফ মজিদপুর ইউপির কাকিয়াখালী গ্রামের প্রয়াত সৈয়দ আলী প্রধানের ছেলে। সৈয়দ আলীও একই ওয়ার্ডে দুবার ইউপি সদস্য ছিলেন। ২০২১ সালে একই ওয়ার্ডের সদস্য নির্বাচিত হন আবু হানিফ। তিনি দীর্ঘ ২৭ বছর সৌদি আবর, সিঙ্গাপুর, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে কাজ করেছেন। ২০১১ সালে স্থায়ীভাবে দেশে চলে আসেন।
এলাকাবাসী সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল শনিবার মজিদপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড জামায়াতের কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ উপলক্ষে সম্প্রতি প্রচারপত্র (লিফলেট) বিতরণ করা হয়। যেখানে অতিথির জায়গায় ৪ নম্বর ওয়ার্ড জামায়াতের সভাপতি হিসেবে আবু হানিফের নাম উল্লেখ করা হয়। গত বৃহস্পতিবার থেকে বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তার আগে স্থানীয় লোকজন হানিফকে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা হিসেবেই জানতেন।
জানতে চাইলে আবু হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, ২০১১ সালে প্রবাস থেকে ফেরার পর তিনি জামায়াতের রাজনীতিতে যুক্ত হন। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে প্রকাশ করতে পারেননি। ২০২১ সালের ইউপি নির্বাচনে প্রতিপক্ষকে বড় ব্যবধানে হারিয়ে ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন। ২০২২ সালে স্থানীয় সাকুরা কিন্ডারগার্টেনে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কমিটি গঠনে সভা হয়। যাঁর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার কথা, তিনি বিদেশে থাকায় ইউপি চেয়ারম্যান তাঁকে সাধারণ সম্পাদক হতে বলেন। চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের নেতা, তাঁর কথা না শুনলে এলাকাবাসী উন্নয়ন বঞ্চিত হবেন—এই কথা ভেবে তিনি পদটি নেন। তবে সবকিছুই মুখে মুখে। এ জন্য তাঁকে কোনো কাগজ দেওয়া হয়নি।
হানিফ বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হলেও আমি মনেপ্রাণে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি করেছি। সম্প্রতি আমাকে ওয়ার্ড জামায়াতের সভাপতি করা হয়েছে। গত ১২ জানুয়ারি লিফলেটটি মানুষের হাতে আসলে বিষয়টি জানাজানি হয়। আমার প্রতিপক্ষ যারা নির্বাচনে হেরেছে, তারাই এখন বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক ছড়াচ্ছে।’
জানতে চাইলে মজিদপুর ইউপির চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম বলেন, হানিফ ৫ আগস্টের পর ভোল পাল্টেছেন। সম্মেলনের মাধ্যমে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কমিটি হয়। ওই পদে একাধিক প্রার্থী ছিলেন। হানিফ শোভাযাত্রা করে লোকজন নিয়ে সম্মেলনে আসেন। অনেক তদবিরের মাধ্যমে পদটি পেয়েছিলেন। পদ পাওয়ার আগেও দলে সক্রিয় ছিলেন। এ জন্য ইউপি সদস্য হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের পদ ছিল সোনার হরিণ। কাউকে জোর করে পদ দেওয়ার সুযোগ ছিল না। কয়েক দিন পর দেখবেন, তিনি বিএনপিও হতে পারেন। জামায়াতের সভাপতি পদ পেয়েছেন। তবে এখনো আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেননি।
পদত্যাগের বিষয়ে আবু হানিফ বলেন, ‘যেহেতু আওয়ামী লীগের পদ দেওয়া হয়েছিল মৌখিকভাবে, তাই আর পদত্যাগ করিনি। প্রকৃত অর্থে আমি জামায়াতের লোক। আওয়ামী লীগের পদ নিয়েছি এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে।’
উপজেলা জামায়াতের আমির মো. শামীম সরকার বলেন, হানিফ দীর্ঘদিন ধরে জামায়াতের রাজনীতি করেন। জামায়াতের সক্রিয় সদস্য। জামায়াতের সমর্থনেই ইউপি সদস্য হয়েছেন। আওয়ামী লীগের পদ নিয়েছিলেন কৌশলগত কারণে। তবে ভেতরে-ভেতরে জামায়াতের সাংগঠনিক কাজ করে গেছেন। তিনি যে জামায়াতের সমর্থনে ইউপি সদস্য হয়েছেন, সেই তালিকা জামায়াতের কেন্দ্রে পর্যন্ত আছে। একটি মহল বিষয়টি নিয়ে এখন বিতর্ক সৃষ্টি করছে।
এ বিষয়ে কুমিল্লা উত্তর জেলা জামায়াতের আমির মো. আবদুল মতিন প্রথম আলোকে বলেন, হানিফ জামায়াতের লোক ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। মজিদপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তাঁকে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হতে বাধ্য করেছিলেন। পরিস্থিতি প্রতিকূল থাকায় তখন তিনি চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে পারেননি। জামায়াতে অনুপ্রবেশের কোনো সুযোগ নেই। হানিফ ইউপি সদস্য হওয়ার প্রায় এক দশক আগে থেকেই জামায়াতের রাজনীতি করেন।