অনাহারীদের খাইয়েই তাঁর যত সুখ

খাবারের একটি বড় অংশ ওয়াজেদ আলী বিতরণ করেন আলমডাঙ্গা রেলস্টেশনে
ছবি: প্রথম আলো

করোনার প্রভাব তখনো রয়ে গেছে। চারদিকে মানবিক বিপর্যয়। ঠিক সে সময় আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসেন ব্যবসায়ী ওয়াজেদ আলী। টানা দেড় বছর রান্না করা খাবার প্যাকেটে ভরে গরিব, দুস্থ, পথচারী ও দিনমজুরদের মধ্যে বিলিয়েছেন। এই সেবামূলক কাজে প্রতি মাসে লাখ দুয়েক টাকা বেরিয়ে গেছে তাঁর। তাতে মোটেও আক্ষেপ নেই চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার কলেজপাড়ার এই ব্যবসায়ীর। কারণ, মানুষের কাছ থেকে অফুরান ভালোবাসা পেয়েছেন তিনি।
২০২২ সালের মে মাসে ৪৫ প্যাকেট খাবার দিয়ে শুরু। এখন প্রতি রাতে ১০০ থেকে ১১০ প্যাকেট খাবার বিতরণ করেন। এই একবেলা খাবারের জন্য দিনভর অপেক্ষায় থাকেন ক্ষুধার্ত অনেক মানুষ। নিরন্ন মানুষের হাতে খাবার পৌঁছে দিয়ে নির্মল আনন্দ পান ওয়াজেদ আলী (৫২)। হাসেন তৃপ্তির হাসি।

পেছনের গল্প

২০১২ সালের ঘটনা! সে সময় আলমডাঙ্গা শহরের পুস্তক ব্যবসায়ী ওয়াজেদ আলী ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ঢাকায় গিয়েছিলেন। সে সময়ের একটি ঘটনায় চোখ আটক যায় তাঁর। অনুষ্ঠান শেষে আয়োজকেরা কমলাপুর রেলস্টেশনের পাশে উচ্ছিষ্ট কিছু খাবার স্তূপ করে রাখে। আশপাশের বস্তি থেকে আসা বিভিন্ন বয়সী শিশু, নারী ও পুরুষ সেখান থেকে খাবার বেছে বেছে পলিথিনে ভরতে থাকেন। তাঁদের কেউ কেউ আধখাওয়া মাংসের টুকরা মুখে পোরেন। কয়েকটা কুকুর উচ্ছিষ্টের দখল নেওয়ার চেষ্টা করেও সুবিধা করতে পারেনি। কিছু পাখিকে মুখে করে খাবার নিয়ে উড়ে যেতেও দেখলেন।
ওয়াজেদ বলেন, ‘সেদিন খাবার নিয়ে মানুষ ও পশুপাখির মধ্যে টানাটানির ঘটনায় খুবই কষ্ট পেয়েছিলাম। সেদিন ঠিক করেছিলাম, কোনো দিন সামর্থ্য হলে অসহায়, দুস্থ, ক্ষুধার্ত মানুষকে খাবার দেব। একসময় শুধু বইয়ের ব্যবসা (ঢাকা বইঘর) ছিল। এখন ঢাকা ফাস্টফুড ও ময়ূরী বেকারি নামে আরও দুটি প্রতিষ্ঠান হয়েছে। এর মধ্যে বেকারি থেকে উপার্জনের প্রায় পুরো টাকা খাবার বিতরণ এবং অন্যান্য সেবামূলক কাজে ব্যয় করা হয়।’

অন্যদের চোখে

নাগরিক সংগঠন আলমডাঙ্গা উপজেলা লোকমোর্চার সভাপতি সাবেক মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা এম সবেদ আলী বলেন, ‘ওয়াজেদ আলী আসলেই মানবিক মানুষ। মানুষকে খাদ্যসহায়তা দিয়ে গেলেও সব সময় তিনি থেকেছেন প্রচার-প্রচারণার বাইরে। আমার গ্রাম গোবিন্দপুরেই ২৮ থেকে ৩০ জনকে দেড় বছর ধরে রাতের বেলায় খাবার দিয়ে আসছেন। অথচ, সম্প্রতি এক রাতে বিষয়টি আমার নজরে আসে। তাঁর সেবার যে মানসিকতা, তা সত্যিই অনুকরণীয়।’
আলমডাঙ্গা ব্রাইট মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ জাকারিয়া হিরো বলেন, ওয়াজেদ আলী অনেক মানবিকতার পরিচয় দিয়েছেন। যাঁরা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল, তাঁদের এ ধরনের মানবিক কাজে এগিয়ে আসা উচিত।
খাবারের একটি বড় অংশ বিতরণ করা হয় আলমডাঙ্গা রেলস্টেশনে। সেখানকার স্টেশন মাস্টার নাজমুল হোসেন বলেন, ‘প্রচারবিমুখ মানুষটি দীর্ঘদিন ধরে রাতের বেলায় খাবার বিতরণ করে আসছেন। অনেক অসহায় মানুষের চলাচল স্টেশনে। এমনকি অনেক অপেক্ষমাণ যাত্রীর কাছে টাকা থাকে না। তাঁদের ক্ষুধা নিবারণে খাদ্যসহায়তা প্রশংসনীয় উদ্যোগ।’

সারথিদের কথা

ওয়াজেদ আলীর মানবিক এই কাজের শুরু থেকেই স্ত্রী সাজেদা খাতুন এবং ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাজিদ হাসান সহযোগিতা করে আসছেন। সাজেদা বলেন, ‘ক্ষুধার্ত মানুষেরা এখন আমাদের পরিবারের সদস্য। অসুস্থতার কারণে কোনো দিন যদি রান্না করার মেয়েটি না আসে, সেদিন আমি নিজেই রান্না করে দিই। রোজার সময় রাতের খাবারের সঙ্গে সাহরিও দেওয়া হয়। ঈদের দিন আমরা যেমন পোলাও, মাংস, মিষ্টি খাই, তেমনি মানুষের জন্যও একই রকম খাবার রান্না করে পৌঁছে দিই।’
ওয়াজেদ জানান, মেয়ে শারমিন আক্তার ও জামাতা সিরাজুম মুনীর খান প্রতি মাসে এক দিনের খাবারের টাকা দেন। এ ছাড়া বেলগাছি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল কাশেম এ পর্যন্ত দুই দিন, ব্যবসায়ী জয়দেব কুমার এক দিনের খরচ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। শুরু থেকেই খাবার তৈরি ও বিতরণে আলমডাঙ্গা বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম, কারখানার কর্মচারী রাজু আহমেদ ও আবদুর রহমান এবং স্থানীয় মুরব্বি চতুর আলী নিরলস শ্রম দিয়ে আসছেন। আলমডাঙ্গা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক ইলিয়াস হোসেন খাবার প্যাকেট তৈরির সময় সহযোগিতা করেন।
ইলিয়াস হোসেন বলেন, এই সেবা ওয়াজেদ আলীকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। কাজটি মোটেও সহজ নয়। পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে তিনি যেভাবে দিনের পর দিন অসহায়, ক্ষুধার্ত, মানসিক ভারসাম্যহীন ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন, তা প্রশংসনীয় ও অনুকরণীয়।
প্রথম দিন থেকেই খাবার রান্নার দায়িত্বে আছেন আফরোজা খাতুন। তিনি বলেন, ‘একেনে রোজ দুপোর থেইকে বিকেল পইযন্ত রান্না হয় ১১০ জুনার। ছয় দিন হিসাপ করে এক দিন মাংস, এক দিন মাছ, এক দিন ডিম, এক দিন সবজি, এক দিন ডাল আর এক দিন খিচুড়ি রান্না করা হয়।’

রান্নাবান্না ও বাজারের কাজ নিজে তদারকি করেন ওয়াজেদ আলী
ছবি: প্রথম আলো

ওয়াজেদের সঙ্গে এক দিন

আলমডাঙ্গা উপজেলা শহরে তিনটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েও দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে তাঁর সেবামূলক কাজে। সম্প্রতি এই প্রতিবেদক ওয়াজেদ আলীর সারা দিনের কাজ পর্যবেক্ষণ করেন। ওয়াজেদ আলী বেলা ১১টার মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারীদের ওই দিনের সার্বিক বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেন। এরপর কর্মচারী আবদুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে যান কাঁচাবাজারে। বাজার করে তা রান্নার জন্য পৌঁছে দেওয়া হয় বেকারির কারখানার রান্নাঘরে। সেখানে বিকেল পর্যন্ত চলে রান্না। এ সময় জোহরের নামাজ ও দুপুরের খাওয়া শেষে আরেক দফায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে যান ওয়াজেদ। আসরের নামাজ শেষে ফিরে আসেন বেকারি কারখানায়। রান্না শেষে খাবার প্যাকেটভর্তি করতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে যায়। এরপর শুরু হয় খাবার পাঠানো। পৌর এলাকার গোবিন্দপুর, ডামোশ, মাদারহুদাসহ কয়েকটি গ্রামে মোটরসাইকেলে দুজন কর্মচারী দিয়ে খাবার পাঠানো হয়। এরপর রাতে ভ্যানে করে বাকি খাবার নেওয়া হয় আলমডাঙ্গা রেলস্টেশনে।
এক প্রশ্নের জবাবে ওয়াজেদ আলী বলেন, ‘প্রতিদিন এতগুলো ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে তিনবেলা না পারলেও একবেলা ভালো খাবার পৌঁছে দেওয়ার ভেতর স্বর্গীয় আনন্দ খুঁজে পাই। প্রতিদিনের মেহমানের তালিকায় গরিব, প্রতিবন্ধী ও মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ যেমন আছেন, তেমনি একসময়ের ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যরাও আছেন। নিভৃত এক পল্লিতে এক দম্পতির কাছে খাবার পাঠানো হয়, যাঁরা দুজনই হাজি। অথচ, সন্তানেরা খোঁজখবর না নেওয়ায় অভুক্ত থাকতে হয় তাঁদের।’