বগুড়ায় ফুটপাত দখল করে দোকানের পসরা, কোটি টাকার চাঁদাবাজির অভিযোগ
বগুড়া শহরের সার্কিট হাউস-কালীবাড়ি মোড় সড়কে সারি সারি ভ্যানে হরেক খাবারের পসরা। পিৎজা, বার্গার, স্যান্ডউইচ, চিকেন শর্মা, মিটবক্স—সবই মিলছে রাস্তার পাশের এসব দোকানে। ক্রেতারা মূলত কিশোর ও তরুণ-তরুণী।
দোকানগুলোতে নেই কোনো আলাদা শেফ। বিক্রেতারাই নিজের হাতে খাবার তৈরি করছেন, পরিবেশনও করছেন। কারও হাতে গ্লাভস নেই, শরীরে নেই অ্যাপ্রোন। বিকেল গড়াতেই এসব ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকানে ভিড় জমছে। কোর্ট হাউস স্ট্রিটের পাশেই আছে ‘পিজ অ্যান্ড বার্গ’, ‘পদ্মা ফুডস’ ও ‘হিলিয়াম রেস্টুরেন্ট’-এর মতো নামীদামি খাবারের দোকান। একসময় সন্ধ্যায় এসব প্রতিষ্ঠানে ক্রেতার ঢল নামত। এখন সে ভিড় চলে গেছে রাস্তার পাশে বসা দোকানগুলোর দিকে।
পদ্মা ফুডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও জলেশ্বরীতলা ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এমদাদ আহমেদ বলেন, ‘অভিজাত এ এলাকায় একটি খাবারের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। অন্তত ১৪টি প্রতিষ্ঠান থেকে সনদ নিতে হয়। এসব নবায়নে প্রতিবছর মোটা অঙ্কের টাকা গুনতে হয়। ভবন ভাড়া, দামি শেফ ও কর্মচারীর বেতন—সব মিলিয়ে খরচ বিপুল। অথচ রাস্তার পাশে ভ্যানে বসা দোকানে বিনিয়োগ মাত্র ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। কোনো সনদ নেই, দোকানভাড়া নেই, কর্মচারীও নেই। শুধু দামে সস্তা বলে ক্রেতারা ঝুঁকছেন ওদিকে। সড়ক দখল করে দোকান বসায় যানজটও বাড়ছে। অভিযোগ করেও প্রশাসনের কাছ থেকে কোনো প্রতিকার মিলছে না।
বগুড়া হোটেল মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এসএম দেলোয়ার হোসেন বলেন, জলেশ্বরীতলা অভিজাত এলাকা। এখানে দোকান দিতে বিপুল বিনিয়োগ লাগে। নামীদামি দোকানে একটি পিৎজার দাম ৫০০ টাকা হলে ভ্রাম্যমাণ দোকানে বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়। স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকলেও ক্রেতারা সস্তা পেয়ে সেখান থেকেই কিনছেন। এতে অভিজাত রেস্টুরেন্টগুলো লোকসানে পড়ছে। এর সঙ্গে তিনি যুক্ত করেন, ‘আমরা স্ট্রিট ফুড ব্যবসার বিরোধী নই। তবে সেটা অভিজাত এলাকা থেকে সরিয়ে পৌর পার্ক, অ্যাডওয়ার্ড পার্কসংলগ্ন সড়ক কিংবা সরকারি আজিজুল হক কলেজের পাশের এলাকায় নিতে প্রশাসনকে অনুরোধ করেছি।’
সড়কজুড়ে দোকান, ভোগান্তিতে শহরবাসী
সম্প্রতি দেখা যায়, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সামনে সড়কের এক পাশে ২০-২৫টি ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকান বসেছে। অন্য পাশে ফলের দোকান। বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আদালত প্রাঙ্গণের সামনে যানজট লেগেই থাকে।
এ ছাড়া পৌরসভা লেন, জেলা খানা মোড়, বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল বাকী সড়ক, মহিলা ক্লাব মোড়, শহীদ আবদুল জব্বার সড়ক, সাতমাথা-সার্কিট হাউস সড়কসহ শহরের নানা সড়কেই বসছে ফুচকা, চটপটি, জুস, ফাস্ট ফুড ও ফলের দোকান।
সাতমাথায় প্রতিদিন বসছে অর্ধশতাধিক দোকান। জিলা স্কুলের সামনে চটপটি ও কাবাবের দোকানগুলোর চেয়ার বসানো হয়েছে ফুটপাত দখল করে। কবি নজরুল ইসলাম সড়ক, থানা মোড়, বড়গোলা, দত্তবাড়ি, কালিতলা—সবখানেই দুই পাশে দোকান।
নামীদামি রেস্টুরেন্ট লোকসানে
জলেশ্বরীতলার ‘জিভে জল’ রেস্টুরেন্টের পরিচালক ফয়সাল চৌধুরী বলেন, ‘প্রশাসন, ভোক্তা অধিকার ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ নিয়মিত অভিযান চালায় আমাদের ওপর। কিন্তু রাস্তায় বসা ফাস্ট ফুড দোকানে কেউ যায় না। পোড়া তেল দিয়ে অস্বাস্থ্যকরভাবে খাবার তৈরি হচ্ছে। ফলে নামীদামি রেস্টুরেন্টগুলো লোকসানে পড়ছে।’
‘শখ সিগনেচার রেস্টুরেন্ট’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনাজ ইসলাম বলেন, ‘অভিজাত এলাকা থেকে ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকান সরানোর দাবি আমরা অনেক দিন ধরেই জানাচ্ছি। প্রশাসনে ধরনা দিয়েও প্রতিকার মেলেনি।’
এ বিষয়ে বগুড়া পৌরসভার প্রশাসক মাসুম আলী বেগ বলেন, সড়ক ও ফুটপাত দখল করে বসা দোকানই শহরের যানজটের বড় কারণ। পৌরসভা থেকে প্রায়ই উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। কিন্তু কিছু সময় পরই দোকানিরা আবার পসরা সাজিয়ে বসে।
‘বারবি কিউ রেস্টুরেন্ট’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল বাসেদ বলেন, ‘একটি অভিজাত রেস্টুরেন্টে কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে হয়। অথচ প্রতিদিন বিকেলে সামনে বসছে ভ্রাম্যমাণ দোকান। এতে আমরা লোকসানে পড়ছি।’
জলেশ্বরীতলা ব্যবসায়ী সমিতির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আবদুর রশিদ বলেন, সড়ক দখল করে দোকান বসায় সব ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এলাকার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে, বখাটেদের আড্ডা বাড়ছে, স্কুল-কলেজের মেয়েরা উত্ত্যক্তের শিকার হচ্ছে।
নেপথ্যে কোটি টাকার চাঁদাবাজি
পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র আমিনুল ফরিদ বলেন, সড়ক ও ফুটপাত দখল করে এসব দোকান বসায় শহরে দিন-রাত যানজট লেগেই থাকে। এতে দুর্ভোগে পড়েন পথচারীরা। এসব দোকান বসার নেপথ্যে আছে কোটি টাকার চাঁদাবাজি।
বগুড়া আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) ও জেলা বিএনপির সহসভাপতি আবদুল বাছেত বলেন, সড়কে দোকান বসে শহর অচল হয়ে পড়ছে। যদি চাঁদাবাজি না থাকে, তাহলে প্রশাসন ব্যবস্থা নেয় না কেন?
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শহরের বিভিন্ন সড়ক ও ফুটপাতে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার অস্থায়ী দোকান বসে। দোকানপ্রতি প্রতিদিন ১০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলা হয়। বছরে এই অঙ্ক দাঁড়ায় কয়েক কোটি টাকায়। অভিযোগ আছে, এই টাকা ভাগ যায় রাজনৈতিক নেতা, পৌরসভার কিছু কর্মচারী ও পুলিশের কাছে। কেউ মাসিক, কেউ দৈনিক ভিত্তিতে এই চাঁদা তোলেন।
তবে বগুড়া সদর ফাঁড়ির পুলিশ পরিদর্শক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সড়কে বসা দোকান থেকে এক টাকাও পুলিশ চাঁদা তোলে না। কেউ পুলিশের নাম ভাঙিয়ে চাঁদা তুললে তাঁকে আমাদের কাছে সোপর্দ করুন। নিয়মিত উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁরা আবার বসে যায়।’
ট্রাফিক পরিদর্শক (প্রশাসন) সালেকুজ্জামান বলেন, ফুটপাত ও সড়ক দখলমুক্ত রাখতে ট্রাফিক পুলিশ নিয়মিত অভিযান চালায়। তবে অভিযান শেষে দোকানিরা আবার বসে পড়ে। ট্রাফিক পুলিশ কোনো চাঁদা তোলে না।