আইসিইউর মেঝেতে রোগীর স্বজনদের বিছানা, খাওয়া–দাওয়া

ফেনী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে কাগজে কলমে ২০ শয্যার দুটি আইসিইউ ইউনিট থাকলেও ১০ শয্যার একটি বন্ধ উদ্বোধনের দিন থেকেই৷ বাকি ১০ শয্যা নিয়ে যে ইউনিট চলছে, তাতে ভেন্টিলেশনসহ জরুরি জীবনরক্ষাকারী সেবা মেলে না। প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও নার্স, পর্যাপ্ত জনবল, নিরাপত্তাকর্মী ছাড়াই চলছে বিশেষায়িত এই সেবা। এ কারণে গুরুতর অসুস্থ রোগীদের ভেন্টিলেশন সাপোর্টসহ অন্যান্য জরুরি সেবার প্রয়োজনে ঢাকা ও চট্টগ্রামের হাসপাতালে পাঠাতে হচ্ছে। পাশাপাশি প্রবেশের বিধিনিষেধ না থাকায় সংক্রমণের ঝুঁকিও তৈরি হচ্ছে।

ফেনী জেনারেল হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) রোগীর শয্যার পাশে মেঝেতে বিছানা পেতে বিশ্রাম নিচ্ছেন এক স্বজন। সম্প্রতি তোলাছবি: প্রথম আলো

কক্ষের দরজায় বড় বড় অক্ষরে লেখা আইসিইউ। বিশেষায়িত এই ইউনিটের দরজায় নেই কোনো নিরাপত্তা প্রহরী। জীবাণুমুক্ত বিশেষ পোশাক ও জুতা পরে আইসিইউতে ঢোকার নিয়ম থাকলেও রোগীর স্বজনেরা তেমন পোশাক ছাড়াই জুতা পায়ে ঢুকছেন। সাধারণ ওয়ার্ডের মতোই শয্যায় অবস্থানরত রোগীর সঙ্গে ছিলেন একাধিক স্বজন। ভেতরেই খাওয়াদাওয়াও করছিলেন কয়েকজন। কেউ রোগীর পাশে মেঝেতে চাদর বিছিয়ে বিশ্রামও নিচ্ছিলেন।

ফেনী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট–আইসিইউ) গিয়ে সম্প্রতি এমন দৃশ্য দেখা গেছে। হাসপাতালটিতে কাগজে কলমে ২০ শয্যার দুটি আইসিইউ ইউনিট থাকলেও ১০ শয্যার একটি বন্ধ উদ্বোধনের দিন থেকেই৷ বাকি ১০ শয্যা নিয়ে যে ইউনিট চলছে, তাতে ভেন্টিলেশনসহ জরুরি জীবনরক্ষাকারী সেবা মেলে না। প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও নার্স, পর্যাপ্ত জনবল, নিরাপত্তাকর্মী ছাড়াই চলছে বিশেষায়িত এই সেবা। এ কারণে গুরুতর অসুস্থ রোগীদের ভেন্টিলেশন সাপোর্টসহ অন্যান্য জরুরি সেবার প্রয়োজনে ঢাকা ও চট্টগ্রামের হাসপাতালে পাঠাতে হচ্ছে। পাশাপাশি প্রবেশের বিধিনিষেধ না থাকায় সংক্রমণের ঝুঁকিও তৈরি হচ্ছে।

জেনারেল হাসপাতালের নতুন ভবনের দোতলার একটি অংশে চলছে ১০ শয্যার একটি ইউনিটের কার্যক্রম। ইউনিটটিতে ১০টি শয্যার মধ্যে ৬টিতে রোগী ভর্তি রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজনেরই কেবল আইসিইউ সেবার প্রয়োজন। বাকি পাঁচজন সাধারণ ওয়ার্ডের রোগী। তাঁদের আইসিইউ সেবা প্রয়োজন না হলেও রাখা হয়েছে পর্যবেক্ষণের জন্য। হাসপাতালটির একই ভবনের ৫ তলার ১০ শয্যার অপর আইসিইউ ইউনিটে তালা ঝুলতে দেখা গেছে। তার পাশে ১০ শয্যার এইচডিইউ ইউনিটও বন্ধ ছিল।

ঘটা করে উদ্বোধন, দায়সারা সেবা

হাসপাতাল সূত্র জানায়, ফেনী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের নতুন ভবনের দ্বিতীয় তলায় ২০২০ সালের ১৭ মে ঘটা করে ১০ শয্যার আইসিইউ সেবা উদ্বোধন করা হয়। পরের বছর ২০২১ সালের মে মাসে হাসপাতালে ইউনিসেফের অর্থায়নে তরল অক্সিজেন ট্যাংক স্থাপন করা হয়। এরপর ২০২৩ সালে একই ভাবনে ৬ তলায় উদ্বোধন হয় আরও একটি ১০ শয্যার আইসিইউ ইউনিটের। কিন্তু উদ্বোধন ও ফটোসেশনের পরপরই ওই ইউনিটের তালা দেওয়া হয়। গত দুই বছরে আর একবারও এই ইউনিট খোলা হয়নি। নিয়োগ দেওয়া হয়নি পর্যাপ্ত জনবল।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, আইসিইউ ইউনিটের জন্য ৩ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, ৯ জন মেডিকেল অফিসার, ৯ জন নার্স, ৯ জন আয়া, ৯ জন ক্লিনার, ৩ জন নিরাপত্তা কর্মীর( সিকিউরিটি গার্ড) প্রয়োজন হলেও কোনো জনবলই নিয়োগ দেওয়া হয়নি। হাসপাতালের জেনারেল ওয়ার্ড থেকে একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ সিনিয়র কনসালট্যান্ট ও কার্ডিওলজিস্ট দিয়ে কোনো রকম চালানো হচ্ছে চিকিৎসাসেবা। তিন পালায় মাত্র ছয়জন নার্স দিয়ে চলছে সেবা কার্যক্রম। অন্য ওয়ার্ডের আয়া ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা এখানে এসে কাজ করছেন।

রোগীর শয্যার পাশে টুল নিয়ে বসে আছেন তাঁর এক স্বজন। ফেনী জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে
ছবি: প্রথম আলো

যেভাবে চলছে আইসিইউ

গত সোমবার সকালে ইউনিটটিতে গিয়ে কোনো চিকিৎসকের দেখা মেলেনি। একজন নার্স ইউনিটের কার্যক্রম চালাচ্ছিলেন। অনুমতি নিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখা গেল, দেয়ালের এক পাশের পলেস্তারা উঠে যাচ্ছে। রোগীর স্বজনের জন্য আলাদা কোনো অপেক্ষমাণ কক্ষ না থাকায় ইউনিটের ভেতরে ও সামনে ভিড় করছেন।

দোতলার ইউনিটের ১০টি শয্যার মধ্যে সচল রয়েছে ৮টি। ১০টি মনিটরের মধ্যে ৮টি মনিটর কাজ করছে। হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা ২৭টির মধ্যে সচল রয়েছে ১৬টি। ২০ বেডের দুটি ইউনিটে ১৬টি ভেন্টিলেশন থাকলেও একটিরও ব্যবহার হচ্ছে না। জরুরি শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র সি-পেপ মেশিন ও বাই-পেপ মেশিন নেই। নেই পোর্টেবল এক্স-রে মেশিন, পোর্টেবল ইকোআল্টা, ইমার্জেন্সি ডায়ালাইসিস, বেড সাইড ইকোকার্ডিওগ্রাম, আলট্রাসাউন্ড ও পর্দা। পরীক্ষার জন্য পর্যাপ্ত রিএজেন্টও নেই।

আইসিইউ ইউনিটের জন্য ৩ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, ৯ জন মেডিকেল অফিসার, ৯ জন নার্স, ৯ জন আয়া, ৯ জন ক্লিনার, ৩ জন নিরাপত্তা কর্মীর( সিকিউরিটি গার্ড) প্রয়োজন হলেও কোনো জনবলই নিয়োগ দেওয়া হয়নি। হাসপাতালের জেনারেল ওয়ার্ড থেকে একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ সিনিয়র কনসালট্যান্ট ও কার্ডিওলজিস্ট দিয়ে কোনো রকম চালানো হচ্ছে চিকিৎসাসেবা। তিন পালায় মাত্র ছয়জন নার্স দিয়ে চলছে সেবা কার্যক্রম। অন্য ওয়ার্ডের আয়া ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা এখানে এসে কাজ করছেন।

ফেনী জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ও কার্ডিওলজিস্ট মো. মাহতাব উদ্দিন আহমেদ আইসিইউ ইউনিটের অতিরিক্ত দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, মেডিকেল কলেজের বাইরে হাসপাতালগুলোতে আইসিইউর যে ইউনিট থাকে, সেসবকে সেকেন্ডারি ইউনিট বলা হয়। বিশেষায়িত ইউনিটটি পরিচালনা করতে গেলে বিশেষায়িত চিকিৎসক ও প্রশিক্ষিত জনবল লাগে। এখানে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের সে অভিজ্ঞতা নেই। যে কারণে এখানে আইসিইউ সেবা দেওয়া যাচ্ছে না। মূলত বিশেষায়িত যত্ন বা এইচডিইউ সেবা দেওয়া হচ্ছে। তা ছাড়া দুটি ফ্লোরে আলাদা আলাদা দুটি আইসিইউ ইউনিট পরিচালনা করা সম্ভব নয়। এটি হয় পাশাপাশি হতে হবে, না হয় একটির কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হবে।

আইসিইউতে অবাধে লোকজনের প্রবেশ নিয়ে জানতে চাইলে মো. মাহতাব উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে জনবল কম। এ জন্য অনেক বিষয় ‘‘ওভারলুক’’ করতে হয়।’

স্যাঁতসেঁতে দেয়ালের প্লাস্টার উঠে গেছে। সেখানেই লাগানো মনিটর। ফেনী জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে
ছবি: প্রথম আলো

আইসিইউ ইউনিটের দায়িত্বরত সিনিয়র স্টাফ নার্স ফারজানা ইয়াসমিন বলেন, জনবল ও সরঞ্জাম (লজিস্টিক সাপোর্ট) না থাকায় মৃত্যুপথযাত্রী রোগীদের ভেন্টিলেশন সেবা দেওয়া যায় না। লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম সচল না থাকায় এটিকে আইসিইউ বলাই যায় না। এসব রোগীকে চট্টগ্রাম কিংবা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠাতে হচ্ছে। মূলত এখানে হাসপাতালের সাধারণ ওয়ার্ড থেকে একটু উন্নত চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

একই শাখায় কর্মরত সিনিয়র স্টাফ নার্স আয়েশা পারভিন বলেন, ‘সার্বক্ষণিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় প্রাথমিক দায়িত্বগুলো আমাদের পালন করতে হয়। চলতি বছরের আগস্ট মাসের প্রথম ১৫ দিনে এই ইউনিটে আটজন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। অর্থসংকটের কারণে আইসিইউর যেসব রোগী ঢাকা-চট্টগ্রাম যেতে পারেন না, তাঁরা এই ইউনিটে কোনো রকম সেবা নিয়ে থাকেন। এ জন্য মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি হয়।’

জনবল ও সরঞ্জাম (লজিস্টিক সাপোর্ট) না থাকায় মৃত্যুপথযাত্রী রোগীদের ভেন্টিলেশন সেবা দেওয়া যায় না। লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম সচল না থাকায় এটিকে আইসিইউ বলাই যায় না। এসব রোগীকে চট্টগ্রাম কিংবা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠাতে হচ্ছে। মূলত এখানে হাসপাতালের সাধারণ ওয়ার্ড থেকে একটু উন্নত চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
আয়েশা পারভিন,  সিনিয়র স্টাফ নার্স  

দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই

আইসিইউ ইউনিটের একটি শয্যায় ভর্তি ছিলেন নিপুঞ্জ কুমার শীল (৮২)। হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত এই রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন। ভেন্টিলেশনের প্রয়োজন হলেও দেওয়া যাচ্ছে না। টাকার অভাবে জেলার বাইরেও নিতে পারছেন না স্বজনেরা। তাঁর জামাতা জগদীশচন্দ্র শীলের সঙ্গে কথা হয় আইসিইউর বাইরে দাঁড়িয়ে। তিনি বললেন, ‘আমার শ্বশুরের অবস্থা গুরুতর। তবু ভেন্টিলেশনে দেওয়া যাচ্ছে না। ঢাকা-চট্টগ্রামে যে নেব, তার সামর্থ্যও আমাদের নেই। এখন শুধু দেখা ছাড়া আমাদের করার কিছুই নেই।’

আইসিইউ ইউনিটে পর্যাপ্ত জনবলসংকট থাকায় উন্নত মানের চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে স্বীকার করেছেন হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) শোয়েব ইমতিয়াজ। তিনি বলেন, এ হাসপাতালে অন্যান্য সেবার সঙ্গে আইসিইউর মতো আধুনিক বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা চালু রয়েছে। তবে নানা সংকটের মধ্যে বিশেষায়িত এ স্বাস্থ্যসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা। পর্যাপ্ত জনবল ও লজিস্টিক সরবরাহ পেলে কাঙ্ক্ষিত এ সেবাটি আরও সুন্দরভাবে দেওয়া যাবে।

ফেনী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মহী উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘১৪ আগস্ট আমি এ হাসপাতালে যোগদান করেছি। হাসপাতালের বিভিন্ন ইউনিট সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। এ হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থেকে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পর্যন্ত জনবলের তীব্র সংকট রয়েছে। পর্যাপ্ত জনবল পেলে আইসিইউসহ বিভিন্ন ইউনিটে সেবার মান আরও উন্নত করা সম্ভব হবে।’