‘কী হবে জানি না, আল্লাহ দিন পার করি দেওছে’

নিত্যপণ্যের বাজারে চড়া দামের কারণে সংসারের খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ইজিবাইকের চালক আবদুস সাত্তার। মঙ্গলবার সকালে দিনাজপুর রেলস্টেশন চত্বরে
ছবি: প্রথম আলো

‘কোন জিনিসখানের দাম বাড়ে নাই, কহেন তো। চাল-ডাল, মাছ-মাংস, শাকসবজি সব জিনিসের দাম বাড়ি গেইসে। আয় কি বাড়িছে হামার? বাড়ি নাই। রমজান মাস শুরু হওছে, রোজা করি হেনে সারা দিন গাড়িও চালান যাইবে না। বিকাল হইলেই বাড়ি যাবা হবি। রমজান মাসোত ভাড়াও কম হয়। বড়লোকগিলার চিন্তা কম, হারা কারঠে চাহির যামো।’

কথাগুলো বলতে বলতে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন ইজিবাইকের চালক আবদুস সাত্তার (৪৩)। বাড়ি দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার ভূষিরবন্দর বৈকুণ্ঠপুর গ্রামে। মঙ্গলবার সকালে দিনাজপুর রেলস্টেশন চত্বরে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। নড়েচড়ে বসে বলে উঠলেন, ‘কী হবে জানি না, আল্লাহ দিন পার করি দেওছে।’

আলাপচারিতায় আবদুস সাত্তার জানালেন, চার মেয়ে, স্ত্রী ও মাকে নিয়ে তাঁর সাতজনের সংসার। একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি তিনি। স্থানীয় একটি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে ইজিবাইকটি কিনেছেন বছরখানেক আগে। সারা দিনে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় করেন। ওই আয় দিয়েই নিজের ও মায়ের ওষুধ, সন্তানদের পড়ালেখা, খাবারের খরচসহ যাবতীয় খরচ জোগাতে হয়। সম্পত্তি বলতে শুধু ভিটেমাটি আছে তাঁর।

আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় হিমশিম খাচ্ছেন সাত্তার। বললেন, গরুর মাংস দিয়ে ভাত খেয়েছেন গত কোরবানির ঈদে। মাঝেমধ্যে মাছ কেনেন। কাটা মুরগির মাংস কেনেন। এখন সেটাও কেনা মুশকিল হয়ে গেছে। মাসখানেক আগে ব্রয়লার মুরগির কেজি ছিল ১৭০ টাকা, এখন ২৩৫ টাকা। প্রতিদিন ২৪০ টাকা দিয়ে ৪ কেজি চাল কিনতে হয়। শাকসবজি, তেল-লবণ, মরিচ পেঁয়াজ কিনতে হয়। তারপর আর কিছুই থাকে না।

আর কথা বলতে পারেন না আবদুস সাত্তার। লুঙ্গিতে চোখ মোছেন। পঞ্চগড় থেকে ছেড়ে আসা দ্রুতযান এক্সপ্রেসের হর্ন বেজে উঠতেই স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে যাত্রীদের দিকে তাকান তিনি। সাত্তারের মতো নিম্ন আয়ের মানুষের প্রায় সবার অবস্থা একই। জীবনে সামান্যতম বিলাসিতা বলতে স্বজনদের বাড়িতে ঘুরতে যাওয়া, ভালোমন্দ খাওয়া। এখন তার লেশমাত্রও নেই। তবু খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার আনন্দ খুঁজছেন তাঁরা। স্বজনদের মুখে হাসি ফোটাতে হন্যে হয়ে ছুটছেন।

দিনাজপুর শহরের মির্জাপুর কলেজমোড় এলাকায় স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে রুটির দোকান চালান সালমা আক্তার (৩৮)। রুটি-সবজির সঙ্গে ছোলামুড়ি, চা বিক্রি করেন। সালমার দোকানের গ্রাহকদের বড় একটা অংশ কলেজের শিক্ষার্থীরা। রমজান মাসে শিক্ষার্থীদের অনেকেই বাড়িতে যাবেন। দোকানে বেচাবিক্রি কমে যাবে। কপালে চিন্তার ভাঁজ সালমার।

সালমা বললেন, ‘গতবার রোজায় চিনি কিনেছি ৬০-৭০ টাকা, এখন সেই চিনি ১২০ টাকা কেজি। অথচ চায়ের দাম ৫ টাকাই আছে। আটা, ছোলা সবকিছুর দাম দ্বিগুণ। কোনোমতে দোকানটা ধরে আছি। পাঁচজনের সংসারে রোজার মাসে খরচও বেশি।’ কথা যেন শেষ হয় না তাঁর। পরক্ষণেই বলে ওঠেন, ‘ভাই, গরিব মাইনসের আল্লাহ আছে, আল্লায় চালাবে।’

মঙ্গলবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বিভিন্ন পেশার ১৫ জনের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। সবাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সংসার চালাতে হিমশিম খাওয়ার কথা বলছেন।

শহরের বাহাদুর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। বিশেষ করে শাকসবজি, মাছ-মাংসের বাজার। আজ ব্রয়লার মুরগির কেজি ২৩৫, দেশি মুরগি ৫০০, সোনালি ৩৩৫, লেয়ার ২৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এক মাস আগেও ব্রয়লার ১৭০, দেশি মুরগি ৪০০, সোনালি ২৮০ ও লেয়ার ২১০ টাকা দরে বিক্রি হয়। অন্যদিকে গরুর মাংস ৭৫০ ও খাসির মাংস ৯০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

সবজির বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতি কেজি ঢেপা বেগুন ৪০ ও কাটালি বেগুন ৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগেও ঢেপা বেগুন ২৫ ও কাটালি বেগুন ৩৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া ফুলকপি ৬০, পটোল ৬০-৭০, লাউ প্রতিটি ৪০, চালকুমড়া ৫০, চিচিঙ্গা ৬০, আলু ২৫-৩০, ঢ্যাঁড়স ৮০, শসা-টমেটো-গাজর ৩০, করলা ১০০, বরবটি ৮০, শজনে ১৪০, কাঁচা মরিচ ৮০-১০০, শিম ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

মিলন সবজি ঘরের স্বত্বাধিকারী ইসমাইল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক পদের সবজি, যেমন বেগুন, টমেটো, শসা, গাজর, কাঁচা মরিচ, লাউ, ঢ্যাঁড়সের দাম এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে ৫ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। তিনি বলেন, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হলেই দাম বাড়ে। রমজান মাসে এসব সবজির দাম আরও বাড়াতে পারে।