মৌলভীবাজারে মারা গেল মহাবিপদাপন্ন ১৪টি শকুন

মৌলভীবাজার সদর উপজেলার একাটুনা ইউনিয়নের তিনটি স্থান থেকে শকুনের মৃতদেহগুলো উদ্ধার করা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার সকালে
ছবি: প্রথম আলো

মৌলভীবাজারে মহাবিপদাপন্ন পাখি শকুনের ১৪টি পচা–গলা মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ১১টি উদ্ধার করেছে প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জোট (আইইউসিএন) বাংলাদেশের গবেষক দল। অন্যদিকে বন বিভাগের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ একই এলাকার মাঠ থেকে আরও তিনটি শকুনের মৃতদেহ উদ্ধার করেছে। আজ বৃহস্পতিবার সকালে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার একাটুনা ইউনিয়নের বরকাপন, বুড়িকোনা ও রসুলপুরের মাঠ থেকে শকুনের এই মৃতদেহগুলো উদ্ধার করা হয়েছে। এই এলাকায় শকুনের একটি নতুন কলোনি আছে।

আইইউসিএনের গবেষক দল এবং বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে, ডাইক্লোফেনাক-জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা কোনো মৃত গবাদিপশুর মাংস অথবা বিষ প্রয়োগে মৃত কুকুর-শিয়ালের মাংস খেয়ে শকুনগুলো মারা যেতে পারে। কালারবাজারসংলগ্ন বরকাপন, বুড়িকোনা ও রসুলপুরের এই মাঠের বিভিন্ন স্থানে মৃত কুকুর ও কুকুর-শিয়ালের দেহাবশেষ পাওয়া গেছে। তবে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নিশ্চিত হতে সরকারিভাবে পরীক্ষার জন্য সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে দুটি শকুন পাঠানো হয়েছে।

আইইউসিএন, বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ এবং স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য একটি শকুনের শরীরে আইইউসিএনের স্যাটেলাইট ট্যাগ লাগানো ছিল। এই শকুনকে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া-আসা করতে দেখা গেছে। আইইউসিএনের গবেষক দল প্রতিদিন শকুনটির চলাফেরা পর্যবেক্ষণ করে থাকে। কিন্তু কয়েক দিন ধরে শকুনটির অবস্থান একই জায়গায় অনড় ছিল। কোনো সিগন্যাল মিলছিল না। এই অনড় থাকার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে শকুনের মৃত্যুর বিষয়টি ধরা পড়ে। আইইউসিএন গতকাল বুধবার (২২ মার্চ) শকুনটির অবস্থান চিহ্নিত করতে পারে। সেই অনুযায়ী, আজ সকাল আটটার দিকে গবেষক দলটি চিহ্নিত স্থান মৌলভীবাজার সদর উপজেলার একাটুনা ইউনিয়নের কালারবাজারসংলগ্ন এলাকায় এসে শকুনের মৃতদেহগুলো দেখতে পায়। গবেষক দলটি ঘটনাস্থল থেকে ১১টি শকুনের মৃতদেহ উদ্ধার করে। শকুনগুলোর মৃত্যুর কারণ জানতে এগুলোকে প্রথমে মৌলভীবাজার সদর পশু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

কিন্তু মৃত শকুনগুলোর শরীরে পচন ধরে গেছে। এ অবস্থায় মৌলভীবাজার পশু হাসপাতালে উন্নত ব্যবস্থা না থাকায় ময়নাতদন্তসহ আনুষঙ্গিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি। পরে সরকারিভাবে উন্নত পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য দুটি মৃত শকুন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে বাকি শকুনগুলোর নমুনা নিয়ে আইইউসিএন তাদের তত্ত্বাবধানে আরও উন্নত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে।

এদিকে কালারবাজারসংলগ্ন বরকাপন, বুড়িকোনা ও রসুলপুরের মাঠ থেকে দুপুরে আরও তিনটি মৃত শকুন উদ্ধার করে বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ। এই মাঠে শকুন ছাড়াও মৃত কুকুর ও কুকুর-শিয়ালের হাড়গোড় পাওয়া গেছে। মাঠের তিনটি স্থানে তিনটি কুকুরের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। সম্প্রতি এই এলাকায় শকুনের একটি নতুন কলোনি পাওয়া গেছে।

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ মৌলভীবাজারের সহকারী বন সংরক্ষক শ্যামল কুমার মিত্র প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মাঠে তিনটি মরা শকুন পেয়েছি। এগুলো ১০ থেকে ১২ দিন আগের হতে পারে। তবে শকুনের দেহ পচে নষ্ট হয়ে গেছে। এগুলো তদন্তের জন্য নিয়ে আসা হয়েছে। এ ছাড়া অন্য প্রাণীর হাড়গোড়ও পাওয়া গেছে। এগুলো শিয়াল-কুকুর বা মৃত ছাগলের হতে পারে।’

সব কটি প্রাণী একই ধরনের বিষক্রিয়ায় মারা গেছে বলে ধারণা করছে শ্যামল কুমার মিত্র। তিনি বলেন, ‘আমাদের অনুমান সব কটি প্রাণীই হয়তো কারও ছাগলকে শিয়াল-কুকুর কামড়াতে পারে। সেই ছাগল হয়তো মারা গেছে। মরা ছাগলের মাংসে বিষ দেওয়া হয়েছে। সেই বিষ দেওয়া মাংস যারা খেয়েছে, তারাই মারা গেছে। এটা অবশ্য অনুমান। তদন্ত শেষে প্রকৃত কারণটা জানা যাবে।’

এদিকে আইইউসিএনের গবেষক দলও প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে, দুটি কারণে শকুনগুলো মারা যেতে পারে। এর একটি হতে পারে হয়তো কুকুর-শিয়ালকে বিষ খাওয়ানো হয়েছে। সেই বিষাক্ত মাংস খেয়ে শকুন মারা যেতে পারে। অন্য কারণটি হতে পারে অসুস্থ গরুর শরীরে পশু চিকিৎসায় ব্যবহৃত ব্যথানাশক ডাইক্লোফেনাক, টিটোফ্লেনাক-জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করা হয়েছে। এ ওষুধ পশুতে ব্যবহার করা হলে আর সেই গরু যদি মারা যায়, সেই গরুর মাংস খেলে সঙ্গে সঙ্গে শকুন মারা যায়।

আইইউসিএন বাংলাদেশের শকুন সংরক্ষণ প্রকল্পের মুখ্য গবেষক সারওয়ার আলম দীপু আজ প্রথম আলোকে বলেন, দেশে ২৬০টি বাংলা শকুন আছে। এর মধ্যে রেমা-কালেঙ্গা ও তৎসংলগ্ন এলাকায় আছে ৬০ থেকে ৮০টি। তার মধ্যে এই অঞ্চলের একটি বড় অংশই মারা গেছে।