উদ্ধার করে রাস্তা পুনর্নির্মাণ করছেন স্থানীয় লোকজন

মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার পশ্চিম রাউৎগাঁও-মোবারকপুর রাস্তার জায়গা উদ্ধারের পরনতুন করে নির্মাণ করা হচ্ছেছবি: প্রথম আলো

মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার রাউৎগাঁও ইউনিয়নের প্রায় অস্তিত্ব বিলীন হওয়া দেড় কিলোমিটার গ্রামীণ রাস্তা উদ্ধার করে নতুন করে নির্মাণ করছেন স্থানীয় লোকজন। নিজেরা চাঁদা তুলে রাস্তাটি নির্মাণকাজ এগিয়ে নিচ্ছেন। কৃষিজমিতে সেচ ও বর্ষায় পানিনিষ্কাশনের জন্য নির্মাণাধীন রাস্তার দুই পাশে ছোট খালও খনন করা হচ্ছে।

স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, ১৯৫৬ সালের ভূমি জরিপের (এসএ) রেকর্ড ও মানচিত্রে রাউৎগাঁও ইউনিয়নের পশ্চিম রাউৎগাঁও থেকে পাশের টিলাগাঁও ইউনিয়নের মোবারকপুর গ্রাম পর্যন্ত রাস্তাটির কথা উল্লেখ আছে। তবে পশ্চিম রাউৎগাঁওয়ে রাস্তার দেড় কিলোমিটার জায়গার দুই পাশের কৃষিজমির মালিকেরা প্রতি মৌসুমে একটু একটু করে কেটে তাঁদের জমিতে ঢুকিয়ে ফেলেন। ফলে রাস্তাটি প্রায় অস্তিত্ব হারায়। প্রায় পাঁচ যুগ রাস্তাটির অস্তিত্ব না থাকায় চলাচলে এলাকাবাসীর ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। সম্প্রতি খোঁজখবর নিয়ে স্থানীয় লোকজন রাস্তাটি উদ্ধার করেন এবং নতুন করে রাস্তাটি নির্মাণ করছেন। এতে অবশ্য সবাই সহযোগিতা করছেন।

মোস্তফা ইবনে মিরাজ নামের পশ্চিম রাউৎগাঁওয়ের এক তরুণের মাথায় প্রথমে রাস্তাটি উদ্ধারের ভাবনা আসে। সিলেট নগরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে চাকরির পাশাপাশি ‘রাউৎগাঁও ফ্রেন্ডস ক্লাব’ নামের স্থানীয় একটি সামাজিক সংগঠনের সভাপতি তিনি। এলাকার মুরব্বিদের সঙ্গে তিনি এ বিষয়ে আলোচনা করেন। সবাই সম্মত হন। তবে এ কাজ কতটুকু ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে অনেকেই শঙ্কিত ছিলেন। মোস্তফা মিরাজ তাঁদের অভয় দেন। এ বিষয়ে তাঁর বাবা সৌদিপ্রবাসী গোলাম মোস্তফার সঙ্গেও কথা বলেন। বাবা তাঁকে সাহস জোগান। এরপর কাজে নেমে পড়েন। স্থানীয় এক জরিপকারীকে এনে ভূমি কার্যালয়ের মানচিত্র দেখে রাস্তার সীমানা চিহ্নিত করেন। মিরাজদের বাড়ির সামনে থেকেই রাস্তার শুরু। তাই নিজেদের খরচে প্রায় ৪০০ ফুট রাস্তা করে ফেলেন। তা দেখে এলাকার অন্যরা চাঁদা তুলে বাকি কাজ করছেন।

মোস্তফা ইবনে মিরাজ বলেন, ‘সরকারি রেকর্ড ও ম্যাপে রাস্তা থাকার কথা জেনে রাস্তাটি উদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু করি। প্রথমে ভেবেছিলাম, জায়গা হয়তো কেউ ছাড়বে না। কিন্তু সবাই সায় দিল। এমনকি চাঁদা তুলে রাস্তা করতেও সবাই রাজি হয়ে গেল।’

৯ ফেব্রুয়ারি সরেজমিনে দেখা যায়, পশ্চিম রাউৎগাঁওয়ে ফসলি জমির বুক চিরে তিন-চার ফুট উঁচু রাস্তা। স্থানভেদে ১২ থেকে ১৫ ফুট চওড়া। খননযন্ত্র (এক্সকাভেটর) দিয়ে দুই পাশের জমি থেকে কাটা মাটি ফেলে রাস্তা করা হচ্ছে। রাস্তাটি স্থানীয় তামেশ্বর নদীর ওপর নির্মিত কালভার্টে ঠেকবে। কালভার্টের বিপরীত পাশে রাস্তার কিছু অংশে ইট বিছানো ও বাকিটা পাকা। আরও ২০০ মিটার হয়ে গেলে কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবে।

রাসেল আফজাল চৌধুরী, জাহিদুল ইসলাম, মুরসালিন আরাফাত চৌধুরী, আনিসুল হকসহ কয়েকজন যুবক রাস্তা নির্মাণকাজ তদারকি করছিলেন। তাঁরা জানান, রাস্তাটি হলে রাউৎগাঁও ইউনিয়নের পশ্চিম রাউৎগাঁও, কালিজুরি, বনগাঁও, আব্দা ও সুতারকান্দি এবং টিলাগাঁও ইউনিয়নের কাজিরগাঁও, বেজাবন ও মোবারকপুর গ্রামের লোকজন উপকৃত হবেন। এসব এলাকার বেশ কিছু শিক্ষার্থী রাউৎগাঁও উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ এবং লংলা আধুনিক ডিগ্রি কলেজে লেখাপড়া করে। শুষ্ক মৌসুমে ধান কাটার পর জমি দিয়ে তারা চলাচল করে। বর্ষায় বিকল্প রাস্তায় অনেক পথ ঘুরে চলাচল করতে হয়। এতে সময় গাড়িভাড়া বেশি লাগে। বর্ষায় এলাকার পানি নিষ্কাশন ব্যাহত হয়। এ ছাড়া শুষ্ক মৌসুমে সেচসুবিধা না থাকায় এখানকার অন্তত ১০০ একর জমিতে রবিশস্য ও বোরো ধানের আবাদ সম্ভব হয় না। রাস্তার সঙ্গে খাল হওয়ায় এই সংকটও কাটবে।

স্থানীয় বাসিন্দা রাশেদুল বলেন, আউশ-আমনের মৌসুম শেষে জমি খালি পড়ে থাকে। সেচের ব্যবস্থা না থাকায় সবজি ও বোরো করা সম্ভব হয় না। এখন রাস্তার পাশ দিয়া খাল হচ্ছে, সেচের সুবিধা পাওয়া যাবে।

রাউৎগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ছিলেন একই এলাকার আবদুল বাছিত। তিনি জানালেন, তাঁর দায়িত্বকালে রাস্তার জমি উদ্ধারসহ রাস্তা নির্মাণে উপজেলা প্রশাসনের কাছে তিনি একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু তা আলোর মুখ দেখেনি। এবার রাস্তার কাজে বাকিদের মতো তিনিও সহযোগিতা করেছেন।

রাউৎগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আকবর আলী বললেন, এলাকাবাসী বড় সাহস দেখিয়েছেন। রাস্তাটি হওয়ায় দুটি ইউনিয়নের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হচ্ছে। সেচ ও পানিনিষ্কাশনেরও সুবিধা হবে। পরবর্তী সময়ে সরকারের কোনো প্রকল্পের মাধ্যমে রাস্তায় ইট বিছানো অথবা পাকা করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।

উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. মেহেদী হাসান বলেন, রাস্তার কাজ শুরুর আগে এলাকার কিছু লোক সীমানা নির্ধারণের জন্য তাঁর কাছে জরিপকারক (সার্ভেয়ার) চেয়েছিলেন। কিন্তু লোকবলসংকটের কারণে দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে রাস্তা নির্মাণে এলাকাবাসীর উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে।