চাকরি ছেড়ে হয়েছিলেন হতাশাগ্রস্ত বেকার, এখন মাসে আয় ৯ লাখ টাকা
মার্কেটিংয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি শুরু করেছিলেন বেসরকারি ব্যাংকে। কিন্তু অন্যের অধীন নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেননি মো. গিয়াস উদ্দিন। ২০১৫ সালে চাকরি ছেড়ে চলে আসেন গ্রামে। এরপর বেকার হতাশাগ্রস্ত হয়ে কী করবেন, বুঝে উঠতে পারছিলেন না। ২০১৮ সালে ধারদেনা করে নতুন একটি উদ্যোগের পথে পা বাড়ান তিনি। সেই গিয়াস উদ্দিন সাত বছরের ব্যবধানে এখন মাসে আয় করেন ৯ লাখ টাকার বেশি।
গিয়াস উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৭ সালে মায়ের থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা আর নিজের ২ হাজার টাকা মিলিয়ে ৩ হাজার ৬০০ টাকা দিয়ে দুটি ছাগল কিনে লালন-পালন শুরু করেছিলেন। তবে বুঝতে পারেন, ছাগলের খামার করে ততটা উন্নতি সম্ভব নয়। ফলে ২০১৮ সালের ১৮ এপ্রিল ছাগল বিক্রির কিছু টাকা ও ঋণ নিয়ে উন্নত জাতের চারটি গাভি কিনে লালন-পালন শুরু করেন। বছর ঘুরতেই সেই গাভি বাছুর জন্ম দেয়। গাভির দুধ বিক্রির টাকায় একটু একটু করে বড় হতে থাকে তাঁর খামার। সেই থেকে ৭ বছরের মাথায় এখন তাঁর খামারে ১২০টি গরু। ১১ জন কর্মচারী স্থায়ীভাবে কাজ করছেন। গরুর দুধ ও বাছুর বিক্রি করে খরচ বাদে এখন তাঁর বছরে আয় প্রায় ১ কোটি ৯ লাখ টাকা।
মো. গিয়াস উদ্দিন গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার মহেশপুর ইউনিয়নের হোগলাকান্দি গ্রামের বাসিন্দা। ২০১৯ সালে তিনি হেলেনা পারভীনকে বিয়ে করেন। তাঁদের একটি মেয়ে আছে। গিয়াস উদ্দিন ২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলায় সফল উদ্যোক্তা (গরু, মিষ্টি ও খামার) তিন শ্রেণিতে শ্রেষ্ঠ হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর খামারটির নাম দিয়েছেন ‘অগ্র ডেইরি ফার্ম’।
সম্প্রতি হোগলাকান্দি গ্রামে অগ্র ডেইরি ফার্মে গিয়ে দেখা যায়, খামারের কর্মচারীরা গরু লালন–পালনে ব্যস্ত। পুরো বিষয়টির দেখভাল করছেন গিয়াস উদ্দিন। খামারের ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলে বাঁ পাশে ৪টি শেডে ১২০টি গরু। একপাশে একটি শেডে ছোট বাছুরগুলো শুয়ে আছে। খামারের চারপাশ দিয়ে ১২ একর জমিতে লাগানো হয়েছে ঘাস।
গিয়াস উদ্দিন কাশিয়ানীর উপজেলার একজন রোল মডেল। তিনি প্রতিটি ক্ষেত্রেই সফলতা পেয়েছেন। তিনি যেমন গরুর খামারে সফলতা পেয়েছেন, তেমনি খামারের দুধ দিয়ে তৈরি বিভিন্ন প্রকারের মিষ্টি, দই, ঘি বিক্রি করেও সফল হয়েছেন।
খামার থেকে দু-তিন মিনিটের পথ হেঁটে গেলেই গিয়াস উদ্দিনের বাড়ি। ওই বাড়ির ঘরের পাশেই অগ্র সুইটস ভিলেজ নামের তাঁর মিষ্টি তৈরির কারখানা। কারখানাটিতে কাজ করছিলেন মন্টু নামের এক শ্রমিক। তিনি বলেন, তাঁর বাড়ি পাবনা। পাঁচ বছর ধরে গিয়াস উদ্দিনের মিষ্টির কারখানায় কাজ করছেন তিনি।
খামারে কথা হয় গিয়াস উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, খামারের ১২০টি গরুর মধ্যে ৬৫টি গাভি, মাঝারি আকারের বকনা বাছুর আছে ৩২টি ও ছোট এঁড়ে বা ষাঁড় বাছুর ২৩টি। ৬৫টির মধ্যে ৪৫টি গাভি প্রতিদিন দুই বেলা ৬০০ থেকে ৬২০ লিটার করে দুধ দিচ্ছে। এর মধ্যে সকালে ৩০০ থেকে ৩১০ লিটার দুধ গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার চারটি মিষ্টির দোকানে বিক্রি করেন। ৬৫ টাকা লিটার দরে গড়ে প্রতিদিন ২০ হাজার টাকার দুধ বিক্রি করেন। সকালের দুধ বিক্রি থেকে মাসে আয় ৫ লাখ ৯৪ হাজার ৭৫০ টাকা, আর বছরে আয় ৭১ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। অগ্র ডেইরি ফার্মে প্রতিদিন খরচ ১৯ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা। সকালে দুধ থেকে যে টাকা আয় হয়, তা কর্মচারীদের বেতন, গরুর খাবার, চিকিৎসা বাবদ ব্যয় হয়।
গিয়াস উদ্দিন জানান, তাঁর বার্ষিক আয় ২ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। গরুর খাবার ও চিকিৎসা, ১১ কর্মচারীর মাসিক বেতন বাবদ বছরে খরচ হয় ১ কোটি ৪৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা। সব খরচ বাদে তাঁর লাভ থাকে ১ কোটি ৮ লাখ ৯৭ হাজার টাকা।
বিকেলে পাওয়া ৩০০ থেকে ৩২০ লিটার দুধ দিয়ে চলে গিয়াস উদ্দিনের অগ্র সুইটস ভিলেজ। খামারের দুধ প্রক্রিয়াজাত করে গড়ে তুলেছেন তিনটি মিষ্টির দোকান। আছে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ‘অগ্র ফুডস’, যার মাধ্যমে সারা দেশে মিষ্টি বিক্রি করেন। প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য বগুড়া থেকে এনেছেন কারিগর। কারখানায় তৈরি হচ্ছে ক্ষীর কাটারি, ইলিশ পেটি, প্যারা সন্দেশ, অরেঞ্জ কেক, লেমন, কেক, কালার কেক, ক্ষীর কাটারি, কাটারিভোগ ও দুই প্রকার দই।
গিয়াস উদ্দিন বলেন, অগ্র সুইটস ভিলেজ থেকে প্রতিদিন গড়ে আয় হয় ৪৫ হাজার টাকা। মাসে ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা, বছরে আয় হয় ১ কোটি ৬২ লাখ টাকা। প্রতিদিন কর্মচারীদের বেতনসহ খরচ হয় ২২ হাজার টাকা। মাসে খরচ ৬ লাখ ৬০ হাজার, বছরে খরচ ৭৯ লাখ ২০ হাজার টাকা। খরচ বাদে বছরে আয় ৮২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। ৬৫টি গাভি থেকে বছরে ৪৫ থেকে ৫০টি বাছুর হয়। এর মধ্যে থেকে প্রতিবছর ১০টি বাছুর খামারে রেখে অন্যগুলো বিক্রি করে দেয়। বকনা বাছুর ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ, এঁড়ে বাছুর ৪৫ হাজার থেকে ৫০ হাজারে বিক্রি করেন। বাছুর বিক্রি করে বছরে আয় হয় প্রায় ২৫ লাখ টাকা।
গিয়াস উদ্দিন জানান, তাঁর বার্ষিক আয় ২ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। গরুর খাবার ও চিকিৎসা, ১১ কর্মচারীর মাসিক বেতন বাবদ বছরে খরচ হয় ১ কোটি ৪৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা। অর্থাৎ সব খরচ বাদে তাঁর লাভ থাকে ১ কোটি ৮ লাখ ৯৭ হাজার টাকা।
হোগলাকান্দি গ্রামের বাসিন্দা জাফর মোল্লা বলেন, ‘গিয়াস উদ্দিনকে দেখে গ্রামের কিছু লোক ইতিমধ্যেই ছোট ছোট খামার গড়ে তুলেছেন। গ্রামে গরুর খামার থাকায় আমরা উপকৃত হয়েছি। এখানে আমরা কাজ করে সংসার চালাতে পারছি। তা ছাড়া গিয়াস উদ্দিন গ্রামের অসহায় দরিদ্র মানুষকে সাহায্য করেন। এই গ্রামে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা, নৌকাবাইচ, খেলাধুলা—এগুলোর সবই আয়োজন করেন গিয়াস উদ্দিন।’
কাশিয়ানী উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা শুভঙ্কর দত্ত প্রথম আলোকে বলেন, ‘গিয়াস উদ্দিন কাশিয়ানীর উপজেলার একজন রোল মডেল। তিনি প্রতিটি ক্ষেত্রেই সফলতা পেয়েছেন। তিনি যেমন গরুর খামারে সফলতা পেয়েছেন, তেমনি খামারের দুধ দিয়ে তৈরি বিভিন্ন প্রকারের মিষ্টি, দই, ঘি বিক্রি করেও সফল হয়েছেন। আমরা চাই, নতুন উদ্যোক্তারা গিয়াস উদ্দিনের কাছে গিয়ে পরামর্শ নিয়ে তাঁদের ব্যবসা শুরু করুক। তাহলে অবশ্যই তারা সফল হবে।’