হাওরপারে নরম আলোয় হেমন্তের এক সকাল
হালকা কুয়াশা ঝরছে হেমন্তের পথে পথে, ধানের খেতে। গ্রামগুলো কুয়াশায় মুড়ি দিয়ে নিঝুম শুয়ে আছে তখনো। হঠাৎ এক-দুজন নারী ও পুরুষ পথে বেরিয়েছেন। এক-দুটি মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা গ্রামীণ পাকা সড়ক ধরে কোথাও ছুটছে। পথের পাশের ঝোপে-ঝাড়ে, ঘাসের পাতায় তখন সারা রাতের ঝরা কুয়াশায় জমে উঠেছে বিন্দু বিন্দু জলের ফোঁটা। সূর্য তখনো জেগে ওঠেনি, নরম আলো হেমন্তের কুয়াশাকে নরম আদরে জড়িয়ে আছে।
মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওরপারে হেমন্তের এই সকাল তখন এ রকমই নিঃশব্দ, কোলাহলহীন। এই নৈঃশব্দের ভেতর কোথাও নীরবতা ভেঙে পথে, ঘাসে ও মাটিতে গাছ থেকে পাতা ঝরছে। হাওরের বুকে অনেক দূর পর্যন্ত অথই জলে কুয়াশা ছড়ানো, মৃদু কুয়াশার চাদর ঝুলছে। জল হাওরের দিকে অনেকটা নিচে নেমে গেছে। মাছ ধরার নৌকাগুলো পাড় থেকে অনেক দূরে দূরে এসে ভিড়ছে।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার চাঁদনীঘাট, একাটুনা-নতুন ব্রিজ সড়ক ধরে যাওয়ার পথে একটা জায়গায় এসে হাওরের দিকে একটি গ্রামীণ পাকা সড়ক চলে গেছে। শনিবার ভোরে সেই সড়ক ধরে কাউয়াদীঘি হাওরের পথে যেতে যেতে কেবলই হেমন্ত ছড়িয়ে ছিল সবুজ ঘাসে, ঝরাপাতায়, ধানের খেতে।
হাওরপারের কাদিপুরে পৌঁছার আগেই কিছুটা কুয়াশা কেটে গেছে। একটু একটু করে পুব আকাশের গ্রামের ওপর দিয়ে সূর্যের উদয় ঘটছে, আলো বাড়ছে। হেমন্তের সকালের নরম রোদ ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। হাওরের বুকে ঝিলমিল করে উঠেছে সকালের রোদ। একঝাঁক সাদা বকপাখি হাওর ও হাওরপারের গ্রামের ওপর দিয়ে উড়ে চলছে অন্য কোথাও। হাওরের মাঠের দিকে উড়ে আসছে একঝাঁক শামুকখোল পাখি।
কাউয়াদীঘি হাওর থেকে রাত জেগে মাছ ধরা শেষে ফিরে আসছেন জেলেরা, মৌসুমী মৎস্যজীবীরা। যাঁরা বর্ষাকালে হাওরে মাছ ধরে জীবিকা চালান। অন্য সময় হাওরপারের খেতে বোরো ধান চাষ করেন। কারও কাঁধে মাছের ভার, কারও কাঁধে বইঠা। কারও কাছে বড় বাসনে জিওল মাছ। তাঁরা যেখানে জলের সীমান্ত শেষ হয়ে গেছে, সেখানে নৌকা বেঁধে রাখছেন। যেটুকুতে এত দিন জল ছিল, সেখানে এখন শাপলা-শালুকের ঝাড়, কচুরিপানা থকথকে হয়ে মিশে আছে মাটির সঙ্গে।
মানুষের আনাগোনা বাড়ছে। কিছু হাঁস জলের মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে, মাথা ডুবিয়ে খাবার খুঁজছে। অনেকে গরু-বাছুর নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন পথে।
হাওরপারে নৌকা নিয়ে ফিরলেন কালাইকোনা গ্রামের আলী আকবর। তিনি জানালেন, সারা রাত একাই মাছ ধরেছেন। তাঁর মাছের ঝাঁপিতে মলা, কাকিয়া, বাইম, ভেদাসহ বিভিন্ন ধরনের ছোট মাছ। সেই মাছ নিয়ে চলে গেলেন কাদিপুর ব্রিজের কাছে মৌসুমি মাছের হাটে। শুধু আলী আকবরই নন, একই রকম আরও অনেকে হাওর থেকে ফিরছেন, নৌকা ভিড়িয়ে গ্রামের দিকে ছুটে যাচ্ছেন।
জেলেদের কাছ থেকে মাছ কিনতে ভিড় করেছেন খুচরা বিক্রেতারা। তাঁরা সেই মাছ গ্রামে ফেরি করে ও বিভিন্ন হাটবাজারে নিয়ে বিক্রি করবেন। কাদিপুর ব্রিজ এলাকায় তখন মানুষের কোলাহল অনেকটাই জমে উঠেছে। দরদাম করে মাছ বিক্রি চলছে। কেনা হয়ে গেলে ক্রেতারা সেই থেকে বিভিন্ন জাতের মাছ আলাদা করছেন। কেউ মাছ নিয়ে গ্রামের দিকে চলে যাচ্ছেন। কেউ আরও কিছু মাছ পাওয়া যায় কি না, সেই অপেক্ষায় বসে আছেন।
হেমন্তের সকালের রোদ চড়া হতে থাকে। সকালবেলার একটু-আধটু শীতের আমেজ আর নেই। সবাই তখন কমবেশি ছায়ার আশ্রয়ে। দুটি চায়ের স্টলে বসে হালকা, উচ্চস্বরে হইচই করছেন অনেকে। একজন সবজির দোকান সাজিয়ে বসেছেন মাছের হাটের মধ্যেই। মাছ বিক্রি করে কেউ কেউ হাতে সবজির ব্যাগ ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরছেন। হেমন্তের এ এক অন্য রকম সকাল।