সংসদের পর উপজেলায় জয়, দলে অবস্থান ফিরে পেতে চান ‘খান পরিবার’ অনুসারীরা

চাচার নামে করা শামসুর রহমান খান স্মৃতি ফাউন্ডেশনের শিক্ষাবৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে আমানুর রহমান খান ও আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই পরিবারের মধ্যে এখন সুসম্পর্কছবি: সংগৃহীত

টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছেন জেলার আওয়ামী রাজনীতিতে বহুল আলোচিত ‘খান পরিবার’ সমর্থিত প্রার্থী। এর আগে এই পরিবারের সন্তান আমানুর রহমান খান ওরফে রানা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন।

গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদে খান পরিবার সমর্থিত প্রার্থীদের কাছে পরাজিত হয়ে হতাশ উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। এর ঢেউ এসে লেগেছে জেলার রাজনীতিতেও। এদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের বিজয়কে কাজে লাগিয়ে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে চায় খান পরিবারের সমর্থিতরা।

জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীরা বলেন, ঘাটাইলে আওয়ামী লীগ গড়ে উঠেছিল খান পরিবারের হাত ধরেই। এই পরিবারের সন্তান শামসুর রহমান খান ওরফে শাহজাহান ঘাটাইল আসন থেকে সাতবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। তিনবার বিজয়ী হন। শামসুর রহমান খান কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দল তাঁকে মনোনয়ন দেয়নি। সেবার দলীয় মনোনয়ন পেয়ে চিকিৎসক মতিউর রহমান সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মতিউর রহমান ২০১২ সালে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম ওরফে লেবু। মনোনয়ন না পেয়ে শামসুর রহমান খানের ভাতিজা আমানুর রহমান খান ওরফে রানা স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন এবং সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমানুর আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হন।

সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার কয়েক মাস পরই জেলা আওয়ামী লীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যা মামলায় আমানুর ও তাঁর তিন ভাইয়ের সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ সামনে আসে। তারপর তাঁরা আত্মগোপনে চলে যান। দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকার পর আমানুর আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। প্রায় তিন বছর হাজতে থাকার পর তিনি জামিনে মুক্ত হন।

সংসদ সদস্য আমানুর রহমানের ঘাটাইলে গণভিত্তি আছে। উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়ন, গ্রাম পর্যায়ে তাঁর অনুসারী আছেন। এ জন্যই আমানুর রহমান ঘাটাইল আসন থেকে বারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
মো. আরিফ হোসেন, নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান, ঘাটাইল উপজেলা পরিষদ

আমানুর ও তাঁর ভাইয়েরা আত্মগোপনে থাকার সময় ঘাটাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ তাঁদের বিরোধীদের হাতে চলে যায়। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আমানুরকে দলীয় মনোনয়ন দেয়নি। দলীয় মনোনয়ন পান তাঁর বাবা আতাউর রহমান খান। তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম ওরফে লেবু চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। আমানুরের বাবা আতাউর রহমান খান সংসদ সদস্য হলেও উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল শহিদুল ইসলামের হাতে। দলের সব পর্যায় থেকে খান পরিবার সমর্থিতরা বাদ পড়েন।

২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমানুরের বাবা আতাউর রহমান খানকে মনোনয়ন দেয়নি আওয়ামী লীগ। দলীয় মনোনয়ন পান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য কামরুল হাসান খান। আমানুর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হন।

এদিকে এবার ঘাটাইল উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী সমর্থিত প্রার্থী হন দলের উপজেলা শাখার সহসভাপতি মো. লোকমান হোসেন। সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান সমর্থন দেন মো. আরিফ হোসেনকে। ২১ মে অনুষ্ঠিত সেই নির্বাচনে আরিফ হোসেন বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয় লাভ করেন।

আমানুর কালো টাকা খরচ করে সংসদ সদস্য হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের কেউ নন। বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যা মামলায় তিনি ও তাঁর ভাইয়েরা আসামি।
হেকমত সিকদার, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, ঘাটাইল উপজেলা আওয়ামী লীগ

জাতীয় সংসদ ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে পরাজয়ের পর হতাশা বিরাজ করছে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহিম নেতা-কর্মীদের হতাশার কথা স্বীকার করে বলেন, উপজেলা নির্বাচনে সংসদ সদস্য তাঁর প্রভাব খাটিয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীকে হারিয়েছেন। তিনি বলেন, দলের উপজেলা শাখার সভা করে পরবর্তীতে কীভাবে দল চালানো হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। নেতা-কর্মীদের হতাশা কাটিয়ে আবার পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।

এদিকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদে বিজয়ী হওয়ার পর খান পরিবার অনুসারীরা উজ্জীবিত। তাঁরা দলের ভেতর অবস্থান আবার ফিরে পেতে তৎপর হয়ে উঠেছেন। আমানুর রহমান খান শুধু উপজেলা নয়, জেলার রাজনীতিতেও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জোয়াহেরুল ইসলাম, সদর আসনের সংসদ সদস্য ছানোয়ার হোসেন, টাঙ্গাইল পৌরমেয়র এস এম সিরাজুল হকসহ দলের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু নেতাকে নিয়ে একটি বলয় সৃষ্টি করেছেন। এ ছাড়া তাঁদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী সিদ্দিকী পরিবারের সঙ্গেও রাজনৈতিক সমঝোতা হয়েছে। সংসদ সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে অতিথি করে ঘাটাইলে তাঁর চাচার (শামসুর রহমান খান) স্মরণে সভা করেছেন। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গেও সুসম্পর্ক এখন।

ঘাটাইল উপজেলা পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান মো. আরিফ হোসেন বলেন, সংসদ সদস্য আমানুর রহমানের ঘাটাইলে গণভিত্তি আছে। উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়ন, গ্রাম পর্যায়ে তাঁর অনুসারী আছেন। এ জন্যই আমানুর রহমান ঘাটাইল আসন থেকে বারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।

আমানুরের অনুসারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য ও আনেহলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তালুকদার মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমানুর রহমান খানের বিজয় এবং উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তাঁর সমর্থিত প্রার্থীর বিজয়ের মধ্য দিয়ে আবার প্রমাণিত হয়েছে যে তিনি ঘাটাইলের গণমানুষের নেতা। তাঁর অনুসারী আমরা কেউ এখন আওয়ামী লীগের কোনো কমিটিতে পদে নেই। এখন কমিটির মেয়াদ শেষে সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার চেষ্টা করব। সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করার জন্য কাজ করে যাব।’

ঘাটাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হেকমত সিকদার বলেন, ‘আমানুর কালো টাকা খরচ করে সংসদ সদস্য হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের কেউ নন। বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যা মামলায় তিনি ও তাঁর ভাইয়েরা আসামি। মামলার সাক্ষ্য শেষ পর্যায়ে। আশা করছি তাঁদের সর্বোচ্চ সাজা হবে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকারীর কোনো স্থান আওয়ামী লীগে হবে না।’