শত বছরেও এমন মৃত্যুর কথা শোনেনি মানুষ

ছোট দুই ভাই ও মাকে হারোনা সায়েমের কান্না থামছেই না। আজ সকালে ফেনীর ফুলগাজীর আমজাদ হাট ইউনিয়নের দক্ষিণ ধর্মপুর ফকির বাড়িতে
ছবি: সংগৃহীত

ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার আমজাদ হাট ইউনিয়নের দক্ষিণ ধর্মপুর গ্রামের শোকাহত লোকজনের হতবিহ্বল ভাব কাটছেই না। গ্রামের সর্বত্রই আলোচনা, এভাবেও মানুষের মৃত্যু হতে পারে! শুকনা খড়ের গাদার নিচে চাপা পড়ে কারও মৃত্যু হয়েছে, গত ১০০ বছরেও এমন ঘটনার কথা গ্রামের লোকজন শোনেননি।

ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার আমজাদহাট ইউনিয়নের দক্ষিণ ধর্মপুর গ্রামের ফকিরবাড়িতে তাই আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই মানুষের ভিড়। শোকার্ত মানুষজন সমবেদনা জানাতে এসেও যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন।

ফুলগাজী উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে ধর্মপুর গ্রাম। ওই গ্রামের ফকিরবাড়ির একটা সেমিপাকা বাড়িতে চার ছেলেমেয়ে ও শাশুড়িকে নিয়ে থাকতেন প্রবাসী মো. আমির হোসেনের স্ত্রী জাহানারা আক্তার (৩৫)। গতকাল বুধবার সকাল ১০টায় এ বাড়িতে যা ঘটে গেল, তা এককথায় অবিশ্বাস্য, অবর্ণনীয়। জাহানারা প্রতিদিনের মতো বাড়ির সামনের খড়ের গাদা থেকে খড় নিয়ে কেটে গরুকে দিচ্ছিলেন। তাঁর দুই ছেলে মো. সাইমুন (৫) ও মো. আবু ছায়েদ (২) মায়ের পাশে খেলছিল।

গাদা থেকে খড় টেনে বের করার সময় হঠাৎ সেটি হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে তাদের ওপর। এতে খড়ের স্তূপের নিচে চাপা পড়ে যান তারা মা-ছেলে তিনজন। খোঁজাখুঁজি করে সেই স্তূপের নিচ থেকে তাঁদের তিনজনকে উদ্ধার করে ছাগলনাইয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলেও ততক্ষণে তাঁদের কেউই আর জীবিত ছিলেন না। হাসপাতালে আনার আগেই তাঁদের মৃত্যু হয় বলে জানান ফুলগাজী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক মিথিলা কানন।

আরও পড়ুন

গতকাল বাদ মাগরিব জানাজা শেষে গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে পাশাপাশি দাফন করা হয়েছে মা ও দুই ছেলেকে। এ ঘটনায় কেবল ধর্মপুর গ্রামের মানুষজন নন, শোক জানাচ্ছেন দেশের বিভিন্ন এলাকার লোকজনও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকেই মর্মান্তিক এ খবর শেয়ার করেছেন। খবর পেয়ে ছাগলনাইয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ছুটে গেছেন ফেনী-১ আসনের সংসদ সদস্য শিরীন আখতার। তিনি ওই শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।

কীভাবে বাঁচবে সুবর্ণা

বাহরাইনপ্রবাসী আমির হোসেন ও জাহানারা আক্তার দম্পতির চার সন্তান রয়েছে। তাদের মধ্যে সবার বড় সন্তান সুবর্ণা শারীরিক প্রতিবন্ধী। সাহায্য ছাড়া চলতে-ফিরতে পারে না মেয়েটি। তাকে ধরে বসানো, খাওয়ানো—সবই করতেন মা জাহানারা। তাদের ১০ বছর বয়সী দ্বিতীয় সন্তান সায়েম স্থানীয় মাদ্রাসায় হিফজ বিভাগে লেখাপড়া করে। মায়ের মৃত্যুর পর সুবর্ণার দেখাশোনার আর কেউ রইল না বাড়িতে। বাড়িতে কেবল বৃদ্ধ দাদি নুর জাহান বেগম (৬৫) আছেন। তিনি নিজেই অসুস্থ।

সুবর্ণার বাবা আমির হোসেন বাহরাইনে থাকলেও তাঁর বৈধ কাগজপত্র নেই। ফলে তিনি সেখানে অবৈধভাবে অবস্থান করছেন। সে কারণে স্ত্রী, দুই ছেলেসহ পরিবারের তিন সদস্যের এমন করুণ মৃত্যুর সংবাদ শুনেও দেশে আসতে পারছে না। স্ত্রী ও ছোট দুই ছেলেকে হারিয়ে আমির এখন দিশেহারা।

প্রবাসী আমির হোসেনের চাচা আলম ফকির মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ভাতিজার সুন্দর সাজানো-গোছানো পরিবার ছিল। হঠাৎ নিমেষেই এভাবে এলোমেলো হয়ে যাবে, কখনো চিন্তাও করিনি। প্রতিবন্ধী সুবর্ণাকে দেখার মতো কেউ নেই। মেজ ছেলে সায়েমের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। আমিরের বাবা তাজুল ইসলাম ফকির দুই বছর আগে মারা গেছেন। তাঁর বৃদ্ধ মা নুরজাহান বেগম খুবই অসুস্থ।’

টিপুর ফুফাতো ভাই শাহ আলম বলেন, জাহানারা সব সময় সন্তানদের আগলে রাখতেন। বৃদ্ধা শাশুড়ি, প্রতিবন্ধী মেয়েসহ ছেলেদের দুধ খাওয়ানোর জন্য একটি গাভি পালতেন তিনি। ওই গাভির জন্য খড় তুলতে গিয়ে দুই শিশুসন্তানসহ তাঁর মৃত্যু হবে, এটা ভাবতেই পারছেন না কেউ।