এক যুগেও গাইবান্ধার হতাহতদের পরিবারগুলোর পুনর্বাসন হয়নি

রানা প্লাজা ভবন ধসে ডান হাত হারানো গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার চকগোবিন্দপুর গ্রামের রিকতা খাতুনছবি: প্রথম আলো

রানা প্লাজা ভবন ধসের ঘটনার এক যুগ আজ ২৪ এপ্রিল। এই দীর্ঘ সময়েও গাইবান্ধার হতাহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর পুনর্বাসনে কোনো ব্যবস্থা হয়নি। তাঁদের অনেকে কষ্টে দিন যাপন করছেন।

গাইবান্ধা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ভবন ধসে গাইবান্ধার ৪৯ জন নিহত হন। এ ছাড়া ১১ জন নিখোঁজ ও শতাধিক আহত হন। ঘটনার পর সরকারিভাবে অনুদান হিসেবে হতাহত ব্যক্তিদের পরিবারপ্রতি ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া সে সময় অনেক পরিবার এই পরিমাণ টাকার চেয়ে অনেক বেশি টাকাও পান। অর্থাৎ সে সময় একেক পরিবার বিভিন্ন পরিমাণে আর্থিক সহায়তা পায়। এরপর গত এক যুগে আর কোনো আর্থিক সহায়তা মেলেনি।

এসব বিষয়ে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, রানা প্লাজা ভবন ধসের ঘটনার পর তাদের পুনর্বাসনের বিষয়ে কোনো সরকারি নির্দেশনা পাওয়া যায়নি।

ডান হাত হারানো রিক্তা ছেলের চাকরি চান

রানা প্লাজা ভবন ধসে ডান হাত হারানো রিক্তা খাতুন (৩০)। তাঁর বাবার বাড়ি সাদুল্যাপুর উপজেলার চকগোবিন্দপুর গ্রামে। অভাবের কারণে ২০০৯ সালে রানা প্লাজার একটি পোশাক কারখানায় চাকরি নেন। রিক্তা বলেন, ধসের ঘটনার দিন কারখানায় তিনি কাজে ব্যস্ত ছিলেন। হঠাৎ হইচই শুনে দৌড় দেন। সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে ছাদের নিচে চাপা পড়েন। ডান হাতের ওপর ইটের দেয়াল ভেঙে পড়ে। চার দিন পর করাত দিয়ে হাত কেটে তাঁকে বের করা হয়।

রিক্তা খাতুন দুই মাস চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফেরেন। ওই সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে কয়েক লাখ টাকা সহায়তা পান। সেই টাকার মাসিক সুদ দিয়ে সংসার চলছে তাঁর।

আরও পড়ুন

গতকাল বুধবার দুপুরে রিক্তা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনার পর থাকি পোত্তেক বচর এপ্রিল মাসের ২৪ তারিখ আইলে হামারঘরে কতা পেপারোত নেকেন, আর কাউয়ো খবোর ন্যায় না। ঘটনার সোমায় সোরকারি কর্তারা চাকরি দেওয়ার কতা বলচিল। আজও সেই চাকরি পাই নাই। হামার চাকরি না হোক। সোরকার যানি হামার ছেলেটার চাকরি দ্যায়। ছেলেটা ডিপলোমা পাস করচে। ট্যাকার অভাবোত বড় কেলাশোত পরব্যার পাচ্চিনে।’

রিক্তা পরিবার নিয়ে বাবার বাড়িতে থাকেন। বাবা মোশারফ হোসেন কৃষক ও মা মোমেনা বেগম গৃহিণী। স্বামী রতন মিয়া কৃষক। রিক্তার এক ছেলে, এক মেয়ে। ছয়জনের সংসার। ছেলে একলাছুর রহমান রংপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে মেকানিক্যাল বিভাগে ডিপ্লোমা পাস করেছেন। মেয়ে মিম আক্তার চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে।

ডান পা হারানো সোনিয়ার সংসার চলছে না

একই ঘটনায় ডান পা হারানো গাইবান্ধার সোনিয়া বেগম (৩১)। সোনিয়ার বাবার বাড়ি একই উপজেলার দামোদরপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ দামোদরপুর গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের সায়েব মন্ডলের মেয়ে। ২০১১ সালে একই ইউনিয়নের পূর্ব দামোদরপুর গ্রামের নজির উদ্দিনের ছেলে মিজানুর রহমানের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পর দুই বছর বেকার জীবন কাটান। সুখের আশায় সোনিয়া-মিজানুর দম্পতি রানা প্লাজার একটি পোশাক কারখানায় চাকরি নেন। চাকরির ২২ দিনের মাথায় ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ভবন ধসের ঘটনা ঘটে। সেদিন মিজানুর অন্য কাজে বাইরে থাকায় বেঁচে যান।

আরও পড়ুন

সোনিয়া বেগম বলেন, ঘটনার দিন সপ্তম তলায় তিনি আটকা পড়েন। কিছু বোঝার আগেই হঠাৎ বিকট শব্দে ভবনটি ধসে পড়ে। দৌড়ে বের হওয়ার সময় তাঁর ডান পা ভবনের একটি বিধ্বস্ত পিলারের নিচে চাপা পড়ে। চেষ্টা করেও পা বের করতে পারছিলেন না। তিন দিন পর উদ্ধারকর্মীরা তাঁকে উদ্ধার করেন। এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাঁর ডান পা কোমরের নিচ থেকে কেটে ফেলা হয়।

সোনিয়া বলেন, পা হারিয়ে কষ্ট করে চলছেন। কিন্তু যাঁদের কারণে পা হারিয়ে পঙ্গু হলেন, সেই দোষী ব্যক্তিদের বিচার দেখতে চান। বর্তমানে তাঁর স্বামী মিজানুর বাড়ির উঠানে মনিহারি দোকান করেন। প্রতি মাসে তিন-চার হাজার টাকা আয় হয়। তা দিয়ে ঠিকমতো সংসার চলছে না। প্রায় সাড়ে চার বছরের ছেলে সিয়াম। মেয়ে মিম্মি আক্তার পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। মিজানুরের বাবা মারা গেছেন। মা মালেকা বেগমকে নিয়ে তাঁদের পাঁচ সদস্যের সংসার। ৫ শতাংশ বসতভিটা ছাড়া কোনো সম্পদ নেই।

সোনিয়ার স্বামী মিজানুর রহমান বলেন, সরকার চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন পর্যন্ত তিনি চাকরি পাননি।

আজও সন্ধান মেলেনি

ভবন ধসে সাদুল্যাপুর উপজেলার কিশামত হলদিয়া গ্রামের আবদুল বারীর মেয়ে বিথী খাতুন (২১) ও সোনা মিয়ার স্ত্রী কামনা খাতুন (২২) নিখোঁজ হন। এখনো তাঁদের সন্ধান মেলেনি। তাঁদের আত্মীয়রা বলেন, টাকা পাওয়া দূরের কথা, কেউ খোঁজও নেয়নি। একই উপজেলার দামোদরপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ ভাঙ্গামোড় গ্রামের দিনমজুর ওয়াহেদ আলীর ছেলে সবুজ মিয়া (১৮) ভবন ধসের ঘটনায় নিহত হন। ঘটনার ১৬ দিন পর মুঠোফোনের সূত্র ধরে ছেলের হাড়গোড় ফিরে পান বাবা-মা। সবুজ মিয়ার এক আত্মীয় বলেন, ‘সোরকার পোত্তেক নিহত পরিবারোত থ্যাকি একঝনাক করি চাকরি দিব্যার চাচিলো। আজো চাকরি দ্যায় নাই।’