‘যারা ট্রেইনে আগুন দিছে, তারা মানুষ না, পশু’

ট্রেনে দুর্বৃত্তের আগুনে পুড়ে মারা গেছেন নাদিরা আক্তার ওরফে পপি ও তাঁর তিন বছর বয়সী ছেলে ইয়াসিন
ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর তেজগাঁওয়ে আজ মঙ্গলবার ভোরে ট্রেনে দেওয়া দুর্বৃত্তদের আগুনে মারা গেছেন নাদিরা আক্তার ওরফে পপি (৩২) ও তাঁর তিন বছর বয়সী ছেলে ইয়াসিন। এই খবরে নেত্রকোনা সদর উপজেলার বরুনা গ্রামে নাদিরার শ্বশুরবাড়িতে চলছে মাতম। স্বজনদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই প্রতিবেশীদের কাছে।

বড় ছেলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষে দুই ছেলেকে নিয়ে প্রথমে বাবার বাড়ি ও পরে শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে যান নাদিরা। গতকাল সোমবার রাতে দুই ছেলে ফাহিম (৮), ইয়াসিন (৩) ও ভাই হাবিবুর রহমানকে নিয়ে নাদিরা নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসা মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রী হন। আজ ভোরে ট্রেনে দুর্বৃত্তরা আগুন দিলে নাদিরার ভাই হাবিবুর বড় ছেলে ফাহিমকে নিয়ে কোনোভাবে ট্রেন থেকে নেমে যান। তবে নাদিরা ও ইয়াসিন বের হতে পারেননি, সেখানেই পুড়ে মারা যান।

নাদিরা নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার আলমপুর গ্রামের ফজলুল হকের মেয়ে। প্রায় ১০ বছর আগে নেত্রকোনা সদর উপজেলার বরুনা গ্রামের আবদুল মজিদের ছেলে মিজানুর রহমানের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। পাঁচ বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে নাদিরা দ্বিতীয়। নাদিরার স্বামী মিজানুর রহমান ঢাকার কারওয়ান বাজারে ‘রহমান এন্টারপ্রাইজ’ নামের একটি হার্ডওয়্যারের দোকান পরিচালনা করেন। স্বামী-সন্তানের সঙ্গে নাদিরা ঢাকার তেজতুরী বাজার এলাকায় থাকতেন। এই দম্পতির বড় ছেলে ফাহিম স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে।

আরও পড়ুন

নাদিরার বাবা ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, আজ ভোর পৌনে পাঁচটার দিকে ছেলে হাবিবুরের কল পেয়ে তাঁরা ঘুম থেকে জাগেন। ছেলের মুখ থেকে ট্রেনে আগুন ধরার খবর শোনেন। একটু পর আবার কল করে হাবিবুর তাঁদের জানান যে নাদিরা আর ইয়াসিন আগুনে পুড়ে মারা গেছে। এরপর তাঁরা সবাই মেয়ের শ্বশুরবাড়ি বরুনা গ্রামে যান। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘বাইচ্যা থাইক্যা সন্তান ও নাতির মরা মুখ দেখলাম। আল্লাহ এমন শাস্তি কেন দিলা?’

৩ ডিসেম্বর রাতে বড় ভাই হাবিবুর রহমানের সঙ্গে নাদিরা তাঁর দুই ছেলে ফাহিম ও ইয়াসিনকে নিয়ে প্রথমে বাবার বাড়িতে বেড়াতে যান। সেখান থেকে কয়েক দিন পর বরুনা গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে আসেন। নাদিরার ভাই হাবিবুর রহমান বলেন, ‘তেজগাঁও রেলস্টেশনে এসে ট্রেনটির গতি থামলে আমাদের পেছনের কয়েক যাত্রী নেমে যান। এরপর ট্রেনটা চলতে শুরু করা মাত্রই পেছনের সিট থেকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। মুহূর্তে তা পুরো বগিতে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর আমি দৌড়ে ফাহিমকে নিয়ে কোনোরকমে নেমে যাই। কিন্তু ইয়াসিনকে কোলে নিয়ে নাদিরা ঘুমিয়ে থাকায় সে আর নামার সুযোগ পায়নি। আমিও তাদের রক্ষা করার সুযোগ পাইনি। চোখের সামনেই আমার বোন ও ভাগনেটা পুড়ে মরল।’

আরও পড়ুন

নাদিরার মা হাওয়া আক্তার বিলাপ করে বলছিলেন, ‘আমার মেয়ে কইতো বাসে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে। তাই ট্রেইনেই বেশি আসা-যাওয়া করত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ট্রেইনেই পুইড়া মরল আমার দুই কইলজার টুকরা। যারা ট্রেইনে আগুন দিছে, তারা মানুষ না, পশু। আল্লায় এদের বিচার করব।’

আরও পড়ুন

নাদিরার শ্বশুর আবদুল মজিদ কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘কয়েক দিন নাতি দুইডারে নিয়া খুব আমোদে আছলাম। নাতি দুইডারে কোলে-কান্ধে নিয়া ঘুরছি। ইয়াসিন দাদা ডাইকাই আমার কোলে উইঠ্যা পড়ত। ইয়াসিনের নামডাও আমিই রাখছিলাম। আর তো কোনো দিন আমার ইয়াসিনরে পাইতাম না।’