নিলামে সরকারি খামারের গরু কিনতে প্রায় ৪০০ আবেদন, দর হাঁকেন মাত্র একজন

মঙ্গলবার রাজশাহীর নিলামে বিক্রি হওয়া ৪০ টি গরুর কয়েকটি। ছবি প্রথম আলো।

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়ীহাটে আঞ্চলিক দুগ্ধ ও গবাদি উন্নয়ন খামারে গতকাল মঙ্গলবার ৪০টি গরু নিলামের নামে বিক্রি করা হয়েছে। নিলামে অংশ নিতে প্রায় ৪০০ ব্যবসায়ী বিডি (আবেদন) জমা দিয়েছিলেন। এর মধ্যে নিলামে অংশ নেন মাত্র চারজন। চারজনের পক্ষে একজন শুধু দর হাঁকেন। এ নিলামে কেনা একেকটি গরু পরে সেখানেই ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেশি দামে বিক্রি করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, বিডি জমা দিয়ে ব্যবসায়ীরা নিলামে অংশ না নিলে তাদের কিছু করার নেই।

স্থানীয় লোকজন বলেন, ওই সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে ছিলেন রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি সালমান ফিরোজ ওরফে ফয়সাল। প্রকাশ্য নিলামে অংশ নেন কালু, বাবু, মেহেরাব ও বাদশা। বাদশা ওই প্রতিষ্ঠানের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। তিনিই সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন মূল্যের চেয়ে মাত্র ২০০ টাকা করে বেশি দিয়ে অন্যদের পক্ষের দর হাঁকেন। বাদশা এক, দুই, তিন বলার সঙ্গে সঙ্গে নিলাম চূড়ান্ত করা হয়। আর কাউকে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়নি। সিন্ডিকেটের বাইরের একজন নিলামে ডাক দিলে তাঁকে বের করে দেওয়া হয়।

প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজনের ভাষ্য, বেলা ১১টায় নিলাম কার্যক্রম শুরু করতে চান কর্মকর্তারা। তখন জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি সালমান ফিরোজ ফয়সাল নিলামের আগে আরেকটু সময় চান। কর্মকর্তারা সময় দেন। এবার নিলামে অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে আলাদা করে কথা বললেন সালমান ফিরোজ। তিনি ‘অনুমতি’ দেওয়ার পর কর্মকর্তারা নিলাম কার্যক্রম শুরু করেন।

খামারের কর্মচারী রইস উদ্দিন তিনটি বাছুরের সর্বনিম্ন সরকারি মূল্য ৭৬ হাজার টাকা ঘোষণা করলেন। কালুর পক্ষে বাদশা দর হাঁকেন ৭৬ হাজার ২০০ টাকা। এরপর অমিত হাসান নামের এক ব্যক্তি ডাকলেন ৭৬ হাজার ৪০০ টাকা। এ সময় বাদশা তাঁকে তেড়ে যান। নিলামে অংশ নিতে না দিয়ে অমিত হাসানকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। সিন্ডিকেটের বাইরে থাকা অমিত গরুর দাম ২০০ টাকা বাড়িয়ে দেওয়ায় বাদশা এবার বাবুর হয়ে দাম হাঁকেন ৭৬ হাজার ৬০০। নিলাম শুরুর দুই মিনিটের মধ্যে এই গরুগুলো এভাবে বিক্রি করা হয়। এরপর আরও তিনটি বাছুরের নিলাম শুরু হয়। তিনটি বাছুরের সর্বনিম্ন সরকারি মূল্য ঘোষণা করা হয় ৯৩ হাজার টাকা। বাদশা একাই গরুগুলোর মূল্য ডাকেন ৯৩ হাজার ৭০০ টাকা। মাত্র ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে নিলাম শেষ করে গরুগুলো তাঁর নামে বিক্রি লেখা হয়। এরপর বাদশা মেহেরাবের নামে একইভাবে ৯৯ হাজার ৬০০ টাকায় তিনটি বাছুর বিক্রি করা হয়।

গরুগুলোর ক্রেতা হিসেবে লেখা হয় খামার কর্মচারী বাদশার নাম। এবার নিলাম কর্মকর্তারা বাদশাকে বলে দেন, অন্তত তিনজনের নামে যেন মূল্য বলা হয়। এসব প্রকাশ্যে বলাবলি হলেও কেউ প্রতিবাদ করেননি। বড় দুটি গাভির সরকারি মূল্য ডাকা হয় ১ লাখ ১৭ হাজার ২০০ টাকা। বাদশা নিজের নামে ডাকলেন ১ লাখ ১৭ হাজার ৪০০ টাকা। এরপর তিনিই মেহেরারের নামে ১ লাখ ১৭ হাজার ৬০০ এবং কালুর নামে ডাকলেন ১ লাখ ১৭ হাজার ৮০০ টাকা। এরপর খামারের পক্ষে সরকারি দর হাঁকা কর্মচারী রইস উদ্দিনকে বাদ দিয়ে বাদশা নিজেই ঘোষণা করলেন, ‘১ লাখ ১৭ হাজার ৮০০ এক, দুই, তিন।’ এভাবে গরুগুলো কালুর নামে কেনা হয়।

নিলামের নামে সিন্ডিকেট করে গরু বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে খামারের উপপরিচালক আতিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় ৪০০ জন বিডি জমা দিয়েছেন। কিন্তু কেউ যদি না ডাকেন, তাহলে তাঁর কী করার আছে। এভাবে নিলাম না করলে পরিবেশ নষ্ট হবে, ঝামেলা হবে। তাই করতে হয়েছে। তিনি বলেন, সেখানে পুলিশ রেখেছিলেন। সবাই নির্ভয়ে অংশ নিতে পারতেন। এর বেশি তাঁর কিছুই করার ছিল না।

খামারের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিলামে অংশ নিতে পারেন কি না, জানতে চাইলে আতিকুর রহমান বলেন, এ বিষয়ে আইনগত কোনো বাধা নেই। সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দেওয়া সালমান ফিরোজকে নিলাম শুরুর আগে পরামর্শ করার সময় দেওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, বিষয়টি তাঁর নজরে পড়েনি। কারও কোনো অভিযোগ থাকলে করতে পারেন। তাঁরা ব্যবস্থা নেবেন।

সিন্ডিকেট করে নিলাম করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হলো কি না, জানতে চাইলে উপপরিচালক বলেন, পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি দর বেঁধে দেয়। তাঁরা ২৩০ টাকা থেকে ২৬০ টাকা কেজি হিসেবে গরুর দর ঠিক করে দেয়। এর সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ইনকাম ট্যাক্স যোগ করে দর নির্ধারণ করা হয়। সেই হিসাবে ৪০টি গরুর সরকার নির্ধারিত মূল্য ছিল ১৫ লাখ ৩০ হাজার ৬০০ টাকা। বিক্রি হয়েছে ১৭ লাখ ৬৩ হাজার ৮০০ টাকায়। সরকারের তো ক্ষতি হয়নি।

অনিয়মের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সেখানে উপস্থিত গোদাগাড়ী থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) নজরুল ইসলাম বলেন, তাঁদের এগুলো দেখার কাজ নয়। তাঁরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষার দায়িত্বে ছিলেন। কেউ কোনো অভিযোগ করেননি।

অভিযোগের বিষয়ে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সালমান ফিরোজের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।