বানার নদে মাছের হুমকি চায়না দুয়ারি 

এ ফাঁদের কারণে জলাশয়গুলো দিন দিন মাছশূন্য হয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ মৎস্যজীবীদের। 

বানার নদের পাড়ে রোদে শুকানো হচ্ছে নিষিদ্ধ চায়না দুয়ারী। গতকাল গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার চিনাডুলি গ্রামেছবি: প্রথম আলো

মিঠাপানির দেশি মাছের বড় উৎস হিসেবে সুপরিচিত গাজীপুরের বানার নদ। সেখানে একসময় মাছ ধরে করে জীবিকা নির্বাহ করতেন অনেক জেলে। তবে এখন মাছ একদম কমে গেছে। শিল্পবর্জ্যের দূষণের পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে নতুন ধরনের চায়না দুয়ারি ফাঁদকেও দায়ী করছেন স্থানীয় জেলেরা।

চায়না দুয়ারিকে স্থানীয়ভাবে জাল বলা হলেও এটি মাছ ধরার বিশেষ একটি ফাঁদ। একে চায়না জাল, ম্যাজিক জাল ও ঢলুক জাল নামেও ডাকা হয়। এ ফাঁদের কারণে জলাশয়গুলো দিন দিন মাছশূন্য হয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ মৎস্যজীবীদের। মৎস্যবিশেষজ্ঞদের মতে, এটা চাঁই বা কারেন্ট জালের চেয়েও ভয়ংকর এক ফাঁদ।

গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার দস্যুনারায়ণপুর এলাকার বানার নদের পাড়ের বাসিন্দাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নদটি দেশি মাছে একসময় ভরপুর ছিল। বিশেষ করে বোয়াল, বাইম, গলদা চিংড়ি, কালবাউশ, রুই মাছের জন্য বিখ্যাত ছিল। বোয়াল মাছ শিকারের জন্য নদের অল্প পানিতে রাতে ‘জিউল’ (জীবন্ত মাছ) দিয়ে বড়শি পাতা হতো। বড় বড় বোয়াল ধরা পড়ত এসব বড়শিতে। এ ছাড়া বাইলা, ছোট চিংড়ি, আইড়সহ নানা জাতের মাছ মিলত এই নদে। কিন্তু ৮ থেকে ১০ বছর ধরে এসব মাছের দেখা পাওয়া যায় খুবই কম। শিল্পকারখানার বর্জ্য বিভিন্ন খাল হয়ে নদে এসে পড়ে পানি দূষিত করে ফেলার কারণে মাছের ক্ষতি হয়েছে। তাঁরা জানিয়েছেন, বানার নদে ময়মনসিংহের ভালুকা অঞ্চল ও নরসিংদীর ঘোড়াশাল অঞ্চলের বিভিন্ন শিল্পকারখানার বর্জ্যের দূষণের কবলে পড়েছে।

বাসিন্দারা আরও জানান, দূষণের পরও নদে যেসব মাছ টিকে ছিল, সেসব মাছকে অস্তিত্ব-সংকটে ফেলেছে চায়না দুয়ারি। প্রায় চার বছর ধরে চায়না দুয়ারি নামের বিশেষ ধরনের মাছ ধরার ফাঁদের ব্যবহার শুরু হয়েছে। এসব ফাঁদ আগে বিলে ব্যবহার করা হতো। তাঁরা জানিয়েছেন, এসব ফাঁদে বড় মাছ তো বটেই, মাছের পোনা, এমনকি ডিম পর্যন্ত আটকে যায়। এতে মাছের বংশবৃদ্ধি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কাপাসিয়ার দস্যুনারায়ণপুর, চিনাডুলি, বাগিয়াসহ বিভিন্ন গ্রামে বানার নদে এসব ফাঁদের ব্যবহার হচ্ছে।

গতকাল সকালে এই তিন গ্রামে সরেজমিনে দেখা যায়, এই গ্রামগুলোতে নদের পাড়ে বিভিন্ন জায়গায় চায়না দুয়ারি নামের ফাঁদগুলো রোদে শুকানো হচ্ছে। অনেকেই আবার ফাঁদের ছেঁড়া অংশ বসে বসে সেলাই করছেন। দস্যুনারায়ণপুর বাজারের পশ্চিম দিকে নদের পাড়ে বেশ কয়েকটি ফাঁদ শুকাতে দেখা গেছে।

বাজারের খেয়াঘাট পার হয়ে বিপরীত পাশে চিনাডুলি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, নদের পাড়ে চায়না দুয়ারি শুকাতে দিয়েছেন বিমল চন্দ্র নামের এক জেলে। পাশেই অন্য একজন ফাঁদের ছেঁড়া জাল সেলাইয়ের কাজে ব্যস্ত। বিমল বলেন, কাপাসিয়ায় বিভিন্ন এলাকায় শত শত চায়না দুয়ারি ব্যবহৃত হচ্ছে। সবাই এসব ফাঁদ ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছেন। তাই তিনি নিজের জীবিকা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এই ফাঁদ ব্যবহার করছেন।

একই গ্রামের চায়না দুয়ারি ফাঁদ দিয়ে মাছ শিকারি নিমাই চন্দ্র বলেন, ‘মাছ কমে গেছে। এসব ফাঁদ ছাড়া এখন মাছ ধরা কঠিন।’ চায়না দুয়ারি দিয়ে মাছ শিকার নিষিদ্ধ, এ কথা জানা আছে কি না, প্রশ্নে নিমাই বলেন, নিষেধ জানা থাকলেও বাধ্য হয়ে তাঁরা এই ফাঁদ ব্যবহার করেন। আশপাশে অন্য লোকজন এই ফাঁদ ব্যবহার বন্ধ করলে তাঁরাও বন্ধ করে দেবেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কাপাসিয়া উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মো. আশরাফুল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছরজুড়ে ২০টি অভিযান ও ১০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত চালিয়েছি। এসব নিষিদ্ধ ফাঁদ বন্ধে আমরা আরও অভিযান পরিচালনা করব।’