আলু বাছাইয়ের যন্ত্র উদ্ভাবন, অপচয় কমবে

যন্ত্রটি আকার, রং ও ত্রুটি নির্ণয় করে আলু বাছাই করতে পারবে। এতে আলুর ক্ষতি অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভাবন করা স্বয়ংক্রিয় আলু বাছাইকরণ যন্ত্রপ্রথম আলো

আলু বাছাইকরণ এবং সংরক্ষণের সমস্যা নিরসনে প্রথমবারের মতো দেশে স্বয়ংক্রিয় একটি যন্ত্র উদ্ভাবনের দাবি করেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। মেশিনটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘অটোমেটেড রিয়েল টাইম পটেটো গ্রেডিং মেশিন’। যন্ত্রটি আকার, রং ও ত্রুটি নির্ণয় করে আলু বাছাই করতে পারবে। এতে আলুর উত্তোলন-পরবর্তী ক্ষতি অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

উদ্ভাবিত যন্ত্রের বিষয়ে প্রথম আলোকে এসব তথ্য জানিয়েছেন যন্ত্রটি উদ্ভাবন গবেষণা দলের প্রধান গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিশক্তি ও যন্ত্র বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আনিসুর রহমান।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে উদ্ভাবক দলের সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমান সময়ে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি আলু উৎপাদিত হচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে আলুর উৎপাদন ছিল ১১ মিলিয়ন টনেরও বেশি। সেই সময় অভ্যন্তরীণ চাহিদা ছিল ৭ দশমিক ৭ মিলিয়ন টন। সে অনুযায়ী আলু উদ্বৃত্ত থাকার কথা ছিল প্রায় ৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন টন, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু যথাযথ সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণের অভাবে অতিরিক্ত ওই উৎপাদনের সবটুকুই অপচয় হয়ে যাচ্ছে। এই ক্ষতি কমানোর লক্ষ্যেই আলু বাছাই যন্ত্রের উদ্ভাবন।

যন্ত্রটির প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে গিয়ে অধ্যাপক আনিসুর জানান, যথাযথ প্রযুক্তির অভাবে দেশের কৃষকেরা হাত ও চোখের আন্দাজেই আলু বাছাই এবং সংগ্রহ করেন। এতে আলু সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও বাজারজাত করা নিয়ে বিপাকে পড়েন কৃষক। দেশের বাজারে প্রতিবছরই আলুর সংকট দেখা দেয় এবং এতে আলুর দাম অনেকটাই বেড়ে যায়। যথাযথ বাছাইকরণ এবং সংরক্ষণের অভাবেই গত বছর প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার সমমূল্যের আলু নষ্ট হয়ে যায়। সঠিকভাবে আলু সংরক্ষণ করা গেলে অতিরিক্ত উৎপাদিত ৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন টন আলু রপ্তানি করা সম্ভব হতো।

‘মেশিন ভিশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে আলুর জন্য স্বয়ংক্রিয় বাছাইপদ্ধতি’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে যন্ত্রটির গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা অর্থায়ন করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সিস্টেম (বাউরেস)। দুই বছর মেয়াদি ওই গবেষণা প্রকল্পের মেয়াদকাল চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে শেষ হয়েছে।

যন্ত্রটির কার্যকারিতার বিষয়ে বলতে গিয়ে প্রধান গবেষক জানালেন, মাঠ থেকে আলু তোলার পর সেগুলো সংরক্ষণের জন্য আকার, রং ও ত্রুটি অনুযায়ী বাছাই করা অন্যতম প্রধান কাজ। কোনো ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া, খালি চোখে আলুর আকার ও রোগ ভালোভাবে বোঝা যায় না। রোগাক্রান্ত আলু নির্ণয় করতে না পারলে তা সংরক্ষিত অন্যান্য আলুর সঙ্গে থেকে সেগুলোকে নষ্ট করে দেয়। উদ্ভাবিত যন্ত্রটির মাধ্যমে এ সমস্যা দূর হবে। যন্ত্রটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিটি আলুর ছবি নেবে এবং তা প্রক্রিয়াকরণ করবে। এরপর আলুর রং, আকার ও রোগাক্রান্ত অংশ শনাক্তকরণের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেবে যে আলুটিকে কোন দিকে পাঠাতে হবে। সে অনুযায়ী মোটরের মাধ্যমে আলু স্থানান্তর করা হবে।

উদ্ভাবকদের দাবি, ছোট, মাঝারি ও বড় আকারের আলু বাছাইয়ে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রটির সফলতার হার প্রায় ৮৬ শতাংশ। বর্তমানে যন্ত্রটি প্রতি ঘণ্টায় ৩০ থেকে ৩৫ কেজি আলু বাছাই করতে পারে। এই গতি ও বাছাই সফলতা আরও কয়েক গুণ বাড়ানোর কাজ চলছে। যন্ত্র উদ্ভাবনের গবেষণাপত্রটি স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার টেকনোলজি নামের বৈজ্ঞানিক জার্নালে জমা দেওয়া হয়েছে এবং তা প্রাথমিকভাবে প্রকাশনার জন্য নির্বাচিতও হয়েছে।

যন্ত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে গবেষণাকাজে নিযুক্ত থাকা একই বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল মাসুম বলেন, স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রটিতে রয়েছে মোটরচালিত ৭ ফুট দীর্ঘ ও দেড় ফুট প্রস্থের কনভেয়ার বেল্ট (আলু পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত বেল্ট), ছবি তোলা ও বিশ্লেষণের জন্য কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত ক্যামেরা। এ ছাড়া রয়েছে এলইডি লাইটিং সিস্টেম এবং বাছাই করা আলুকে সুনির্ধারিত স্থানে রাখতে সার্ভো মোটর ও মাইক্রো কন্ট্রোলারের সমন্বয়ে নিক্ষেপণ পদ্ধতি। যন্ত্রটিতে ছবি বিশ্লেষণের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ম্যাটল্যাব (একটি উন্নত প্রোগ্রামিং ভাষা), যা খুবই অল্প সময়ে আলুর আকার নির্ধারণ এবং পূর্বনির্ধারিত আলুর আকারের সঙ্গে তুলনা করে সিদ্ধান্ত দিতে পারে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যন্ত্রটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে তিন আকারের আলু বাছাই করতে পারে। কম্পিউটার প্রযুক্তিনির্ভর হওয়ায় খালি চোখে দৃষ্টিগোচর না হওয়া সব ত্রুটিও ধরা পড়ে যন্ত্রটিতে। ফলে যথাযথভাবে কম সময় ও পরিশ্রমে আলু সংরক্ষণ করা সম্ভব। আর উৎপাদিত অতিরিক্ত আলু সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবেন কৃষকেরা।