দেড় বছরে ৫৫ দিন হাসপাতালে এসেছেন স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ, সেবাবঞ্চিত কয়রার নারীরা
খুলনার কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্ত্রীরোগ (গাইনি) বিশেষজ্ঞ ফাতেমা জোহরা নিয়মিত কর্মস্থলে আসেন না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ২০২৩ সালে তিনি মাত্র ১৭ দিন এবং চলতি বছরের ছয় মাসে মাত্র ৩৮ দিন অফিস করেছেন। কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় একাধিকবার কারণ দর্শানোর নোটিশ পেয়েছেন তিনি। বেতনও বন্ধ রাখা হয়েছে। তারপরও তিনি কর্মস্থলে হাজির না হওয়ায় জেলা সিভিল সার্জন বরাবর অভিযোগ দিয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ।
খুলনা জেলা শহর থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কয়রা। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেবাপ্রত্যাশী ব্যক্তিরা বলছেন, নিয়মিত চিকিৎসক না পাওয়ায় উপকূলের নারীরা স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বিশেষ করে স্থানীয় অন্তঃসত্ত্বা নারীদের দুর্দশা বেড়েছে। অতিরিক্ত টাকা খরচ করে তাঁদের বিভিন্ন ক্লিনিক ও বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করাতে হচ্ছে।
কয়রার মহারাজপুর এলাকার বাসিন্দা কামাল হোসেন বলেন, উপকূলীয় দুর্গম এলাকার চিকিৎসাবঞ্চিত নারীদের কথা বিবেচনা না করেই চিকিৎসক ফাতেমা জোহরাকে বারবার খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সংযুক্ত করা হচ্ছে। যে কয়েক দিন তাঁর কয়রায় দায়িত্ব পালনের কথা, তিনি তা–ও থাকেন না।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, কয়েক বছর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জুনিয়র কনসালট্যান্ট (গাইনি অ্যান্ড অবস) পদটি ফাঁকা ছিল। ২০২২ সালের ৬ ডিসেম্বর স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ হিসেবে জুনিয়র কনসালট্যান্ট পদে যোগ দেন ফাতেমা জোহরা। তবে যোগদান করেই চলে যান খুলনা শহরে। তৎকালীন খুলনার সিভিল সার্জন সুজাত আহমেদ তাঁকে খুলনার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ নেন। পরে স্থানীয় লোকজনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি তৎকালীন সিভিল সার্জন ওই নির্দেশ বাতিল করে তাঁকে আবার কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ফেরত পাঠান। সর্বশেষ গত ১৮ মার্চ জোহরাকে সপ্তাহে তিন দিন খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন খুলনা স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক। চলতি বছরের ২৩ জুন পর্যন্ত তিনি কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩৮ দিন দায়িত্ব পালন করেছেন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য, লবণাক্ততার কারণে উপকূলীয় এই এলাকার নারীরা নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বা নারীরা উপযুক্ত চিকিৎসা না পেয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে দিনযাপন করছেন। কয়রার প্রত্যন্ত এলাকা থেকে জেলা শহরে যেতে পাঁচ–সাত ঘণ্টা সময় লাগে। খরচ সামলে উঠতে না পেয়ে অনেকে পল্লিচিকিৎসকের দ্বারস্থ হন। এতে প্রায়ই ভুল চিকিৎসার শিকার হন নারীরা।
কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, দেড় বছর ধরে কয়রা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অস্ত্রোপচার বন্ধ। ফলে অন্তঃসত্বা নারীরা এখন আর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সমুখী হন না। তাঁরা সন্তান প্রসবের সময় বাড়িতে থাকছেন কিংবা নিম্নমানের ক্লিনিকে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অপচিকিৎসায় একাধিক মাতৃমৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির ডিজিটাল হাজিরার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ফাতেমা জোহরা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উপস্থিত ছিলেন না। একই বছরের অক্টোবরে ৪ দিন, নভেম্বরে ৭ দিন ও ডিসেম্বরে ৬ দিন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ছিলেন। অর্থাৎ ২০২৩ সালে ২৯৬ কার্যদিবসের মধ্যে মাত্র ১৭ দিন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসেছিলেন। যার মধ্যে ১৫ দিন দেরিতে কর্মস্থলে যান। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৮ দিন, ফেব্রুয়ারিতে ৬ দিন, মার্চে ৭ দিন, এপ্রিলে ৫ দিন, মে মাসে ৮ দিন ও জুন মাসের ২৩ তারিখ পর্যন্ত ৪ দিন তিনি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেবা দিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চিকিৎসক ফাতেমা জোহরা নিয়মিত অফিস করেন বলে দাবি করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি বায়োমেট্রিক মেশিনে ফিঙ্গার দিই। তবে কেন হাজিরা উঠছে না, এটা আমি জানি না।’ হাসপাতালে অস্ত্রোপচার বন্ধ থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ওটি (অস্ত্রোপচার কক্ষ) রেডি (প্রস্তু) করে দিলে অপারেশন করতে আমার কোনো বাধা নেই। তবে জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়া মেশিন না থাকায় যিনি অ্যানেস্থেসিস্ট রয়েছেন, তিনি রিস্ক নিতে চান না। স্পাইনাল দিয়ে অচেতন করলে হার্ট ফেল হওয়ার শঙ্কা থাকে।’
সম্প্রতি বেশ কয়েক দিন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে চিকিৎসক ফাতেমা জোহরার দেখা পাওয়া যায়নি। চিকিৎসাপ্রত্যাশী কয়েকজন নারী বলেন, তাঁরা সেবা নিতে হাসপাতালে গিয়েও গাইনি চিকিৎসককে পাননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন অভিযোগ করেছেন, গাইনি চিকিৎসক (ফাতেমা) মাঝেমধ্যে হাসপাতালে আসলেও দায়সারা চিকিৎসা দিয়েছেন। রোগীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছেন।
কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, অধিকাংশ সময় চিকিৎসক ফাতেমা জোহরা সপ্তাহে দুই দিন এসেছেন। বহির্বিভাগে রোগী দেখে চলে যান। অনিয়মিত অফিসে আসায় তাঁকে বারবার সতর্ক করা হয়। এরপর একাধিক বার কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) দেওয়া হয়েছে। একপর্যায়ে বেতন বন্ধ করার পরে নিয়মিত আসার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিলে বেতন ছাড়া হয়। পরে আবার অনিয়মিত হলে সিভিল সার্জন বরাবর লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে বেতনও বন্ধ রাখা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, চেতনানাশক মেশিন না থাকায় হাসপাতালের অস্ত্রোপচার কক্ষ (ওটি) বন্ধ রয়েছে। উপকূলীয় দুর্গম এলাকা হওয়ায় অস্ত্রোপচার চালু করা খুবই জরুরি।
জেলা সিভিল সার্জন মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা যে শোকজ ও অভিযোগ করেছেন, সেগুলোর অনুলিপি তিনি ঢাকায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) বরাবর পাঠাবেন। এ বিষয়ে ডিজি অফিস পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে।