‘বিএনপির অস্তিত্ব রাখতাম না এই দেশে’

গ্রাম্য সালিসে এক বৃদ্ধ এবং বাদীপক্ষের লোকজনকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা ইউপি সদস্য নজরুল ইসলাম। গাজীপুরের শ্রীপুরের বরমী ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কায়েতপাড়া গ্রামে
ছবি: ভিডিও থেকে সংগৃহীত

গাজীপুরের শ্রীপুরের বরমী ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড কায়েতপাড়া গ্রামে গ্রাম্য সালিসে এক বৃদ্ধ এবং সালিসে বিবাদীপক্ষের লোকজনকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছেন স্থানীয় ইউপি সদস্য। বিবাদীপক্ষের লোকজনকে বিএনপিদলীয় উল্লেখ করে ওই এলাকায় দলটিকে নিশ্চিহ্ন করার হুমকি দিয়েছেন তিনি। অভিযুক্ত ইউপি সদস্যের নাম নজরুল ইসলাম। তিনি ওই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ছিলেন।

সালিসে ইউপি সদস্যের গালিগালাজের ১২ মিনিট ৩৭ সেকেন্ডের একটি ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত শুক্রবার সকালে কায়েতপাড়া গ্রামে ওই গ্রাম্য সালিস বসেছিল। এতে উপস্থিত ছিলেন ইউপি সদস্য নজরুল ইসলাম ছাড়া আরও ২০-২৫ জন। কায়েতপাড়া গ্রামের মো. হানিফ ও হারুন অর রশিদের মধ্যে জমি নিয়ে সমস্যা নিরসনে সালিসটি বসে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, সালিসে উপস্থিত ৬৫ বছর বয়সী ইলিয়াস হোসেনের উদ্দেশে ইউপি সদস্য নজরুল ইসলাম আঞ্চলিক ভাষায় গালিগালাজ করেছেন, যা ছাপার অযোগ্য।

এ ছাড়া সালিসে বিবাদীপক্ষের প্রতিনিধি কায়েতপাড়া গ্রামের বিল্লাল হোসেনের ছেলে হারুন অর রশিদকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। একপর্যায়ে হারুনকে মারতে উদ্যত হন। এ সময় সালিসে উপস্থিত কয়েকজন ইউপি সদস্যকে শান্ত করেন। ইউপি সদস্য হারুনের উদ্দেশে বলতে থাকেন, ‘অনুমতি ছাড়া কথা বললে একদম ঠেঙায়ালায়াম। তগরে বাইরায়াম। তগরে বাইরায়াম, কইছি তো।’ এ কথা বলতে বলতে ইউপি সদস্য মুঠোফোনে ইউনিয়ন পরিষদের আনসার সদস্যকে কল দিয়ে ঘটনাস্থলে আসতে বলেন। সঙ্গে করে ‘বেন্দা’ নিয়ে আসতে বলেন।

এরপর এক নারীকে বলতে শোনা যায়, ‘মেম্বরে বিচারের মধ্যে আবার মারে কীভাবে, ঘুষ খাইছে নাকি।’ এই কথা শুনেই ইউপি সদস্য তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন। তিনি চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে আবারও ছাপার অযোগ্য ভাষায় গালিগালাজ করে হারুন অর রশিদ ও ওই নারীর দিকে এগিয়ে যান। এ সময় সেখানে হারুন অর রশিদের মা হাসেন বানু প্রতিবাদ করলে তাঁকে উচ্চ গলায় গালিগালাজ করেন ওই ইউপি সদস্য নজরুল ইসলাম।

ভিডিওতে দেখা যায়, ইউপি সদস্য একপর্যায়ে সালিসে উপস্থিত বিবাদীপক্ষের লোকজনের উদ্দেশে বলেন, ‘তোরা বিএনপি করস। বিএনপির অস্তিত্ব রাখতাম না এই দেশে। কিসের বিএনপি করতে আইছস এইহানে…বাচ্চারা। তগর একটারো জানে পানি থাকত না এই কাইতপাড়াত।’

এ সময় হারুন অর রশিদের মা হাসেন বানু বলেন, ‘এইতা কী করে এই মেম্বার। পণ্ডিত মেম্বার আছিন না? হে তো এমন করছে না।’ এ কথা শুনে ইউপির সদস্য নজরুল ইসলাম আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। উল্লেখ্য, আলী আমজাদ ওরফে পণ্ডিত ইউনিয়ন পরিষদের ওই ইউনিয়নের সাবেক সদস্য।

ভিডিওর একপর্যায়ে দেখা যায় উত্তেজিত হয়ে ইউপি সদস্য বাদীকে বলছেন, ‘আমি শুক্কুইরার পুত মেম্বর অইছি, আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। সাবেক ওয়ার্ডের (আওয়ামী লীগের) সভাপতি। এইহানো কে কী, আমি জানি। আমি নাটের গুরু বুইজ্যা নেতা অইছি।’ একপর্যায়ে তিনি বলেন, ‘আমার খেলা শুরু অইছে। আমি তো অহন প্রতিশোধই নিতারছি না।...মস্তানি ছুডায়াম তর আমি। কোন নেতারে আনবে, আন।’

ভিডিওর বিষয়ে খোঁজ নিতে আজ সোমবার সরেজমিনে কায়েতপাড়া গ্রামে গিয়ে গত শুক্রবার অনুষ্ঠিত গ্রাম্য সালিসে উপস্থিত লোকজনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। ওই বৈঠকে উপস্থিত ইলিয়াস হোসেনের কাছে গ্রাম্য সালিসে ইউপি সদস্য তাঁকে কী বলেছিলেন, জানতে চাইলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। ইলিয়াস বলেন, ‘আমার বাবা এই এলাকায় বিভিন্ন বিচার সালিসে যেতেন। আমাকেও মানুষ সম্মান করে গ্রাম্য সালিসে নিয়ে যান। শুক্রবার ওই সালিসে যাওয়ার পর যেভাবে গালি খেয়েছি, আমি হার্টের রোগী। এত মানসিক কষ্ট জীবনে পাইনি। আমি একসময় বিএনপি সমর্থক ছিলাম। কিন্তু বহু বছর ধরে আমি কোনো রাজনীতিতে নাই, আমি অসুস্থ।’

গ্রাম্য সালিসে উপস্থিত অপর নারী ফিরুজা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত জঘন্য ভাষায় আমাকে মেম্বার গালিগালাজ দিয়েছে, যেটা মেনে নেওয়ার মতো না’। ওই সালিসে উপস্থিত আরও অন্তত পাঁচজন জানিয়েছেন উত্তেজিত ইউপি সদস্যকে তাঁরা না থামালে সেখানে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটত।

সালিসের বিবাদীপক্ষের প্রতিনিধি হারুন অর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা রাজনীতি করি না। আমি গরিব মানুষ। আমার কেউ নাই। আমার পক্ষে থাকলে মেম্বারের লাভ নাই। আমার এখানে গোষ্ঠী নাই, লাডি নাই। নানার কাছ থেকে পৈতৃক সূত্রে আমার মা হাসেন বানু জমি পায়। কিন্তু জমিতে নানা ঘর করতে দিয়ে গেলেও মামা জমি থেকে উচ্ছেদ করতে চান। সালিস ডেকে মেম্বার এনে এই জমি থেকে উচ্ছেদ করতে চেষ্টা করা হচ্ছে। মেম্বার তাঁদের পক্ষ হয়ে সালিসে আসেন। আমাকে খুবই খারাপ ভাষায় গালিগালাজ করতে করতে গায়ে হাত তুলতে চেয়েছেন। লোকজন তাঁর হাত থেকে আমাকে বাঁচিয়েছে।’

অভিযুক্ত বরমী ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য নজরুল ইসলাম ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ও গালিগালাজের বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে ওইখানে মেরে ফেলতে চাইছিল। ওরা সবগুলো বিএনপি। ওরা পরিকল্পিতভাবে সালিসের মধ্যে আমাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছিল। পরে আমি চৌকিদার আনছি।’

এ বিষয়ে শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তরিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। এ রকম যদি ঘটে থাকে, ভুক্তভোগী কেউ যদি অভিযোগ দেয়, তাহলে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’