নৌকাবোঝাই গোলপাতা নিয়ে ফিরেছেন বাওয়ালিরা, ক্রেতা কম

নৌকা থেকে গোলপাতার বোঝা কাঁধে নিয়ে বাড়ি ফিরছেন এক বাওয়ালি। আজ শনিবার সকালে কয়রা উপজেলার ৪ নং কয়রা গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের গোলপাতা আহরণের সময়সীমা শেষ হয়েছে বেশ কয়েক দিন আগে। গোলপাতাবোঝাই নৌকাগুলো ফিরে এসেছে লোকালয়ে। বাড়ি ফিরে বাওয়ালিরা এখন গোলপাতা বিক্রিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। তবে বাওয়ালিদের দাবি, গোলপাতার কদর এখন আর আগের মতো নেই। তাই এখনো ক্রেতাদের তেমন সাড়া মিলছে না।

শনিবার সকালে কয়রার শাকবাড়িয়া নদীর পাড়ে কথা হয় বাওয়ালি কামরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সুন্দরবনের মধ্যে গোলপাতা কাটতি কোনো অসুবিধে হয়নি। তবে এখন বেচাবিক্রিতে যত অসুবিধা। আগে গোলপাতা কাটতি যাওয়ার আগে অনেকে আগাম গোলপাতা কেনার জন্যি টাকা দিত। আর এখন আগাম দূরে থাক, পাতা ডাঙায় (লোকালয়ে) আনার পরেও কিনতেছে না। গত এক সপ্তায় মাত্র এগারো পোন (৮০টি পাতায় এক পোন) পাতা বিক্রি করিছি।’ প্রতি পোন গোলপাতা ১৮৭ টাকায় বিক্রি করেছেন তিনি।

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এবার সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের দুটি কূপে (গোলপাতা কাটার এলাকা) গোলপাতা কাটার মৌসুম শুরু হয় ২৯ জানুয়ারি থেকে। প্রথম দফায় ২৮ দিনের অনুমতি পেয়ে প্রতিটি ৫০০ মণ ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ১১১টি নৌকা নিয়ে ৫৫৫ জন বাওয়ালি সুন্দরবনে ঢোকেন। এ সময় তাঁরা গোলপাতা আহরণ করেন ২০ হাজার ৫৮২ কুইন্টাল। এতে রাজস্ব আদায় হয় ১২ লাখ ৪২ হাজার ৪২৩ টাকা। একইভাবে ১ মার্চ থেকে দ্বিতীয় দফায় ৮৯টি নৌকার অনুমতি নিয়ে গোলপাতা আহরণে যান ৪৪৫ জন বাওয়ালি। এ সময় ১৬ হাজার ৪৭৮ কুইন্টাল গোলপাতা আহরণের জন্য রাজস্ব আদায় করা হয় ৯ লাখ ৯৬ হাজার ১৭৭ টাকা। এভাবে দুই দফায় ৩৭ হাজার ৬০ কুইন্টাল গোলপাতা কর্তনে ভ্যাটসহ রাজস্ব আদায় হয়েছে ২৫ লাখ ৭৪ হাজার ৮০০ টাকা।

সকালে সুন্দরবনসংলগ্ন ৪ নম্বর কয়রা গ্রামের শাকবাড়িয়া নদীর পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, নদীর বেড়িবাঁধের গা ঘেঁষে স্তূপ আকারে কেটে আনা গোলপাতা সাজিয়ে রাখছেন বাওয়ালি আবুল হাসান। নদীর পাড়ে বাঁধা রয়েছে গোলপাতাবোঝাই বড় নৌকা। ওই নৌকা থেকে এক ব্যক্তি গোলপাতার বোঝা কাঁধে করে বয়ে এনে আবুল হাসানের কাছে দিচ্ছেন।

স্তুপ করে রাখা হয়েছে সুন্দরবনের গোলপাতা, তবে এখনো ক্রেতাদের তেমন সাড়া মিলছে না
ছবি: প্রথম আলো

গোলপাতা সাজানোর ফাঁকে বাওয়ালি আবুল হাসান বলেন, ‘এখন আর আগের মতো গোলপাতায় ব্যবসা নেই। ১ কাউন (১২৮০টি পাতায় ১ কাউন) গোলপাতা ২ হাজার ৭০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। সুন্দরবনের পারমিট নিয়ে শ্রমিক খাটিয়ে গোলপাতা কেটে আনতে যে খরচ হয়, বিক্রি করে সেই খরচও ওঠে না। এখন টিনের দাম ম্যালা (অনেক) কম। যার জন্যি মানুষ আর গোলপাতা কিনতি চায় না। তারপরও কোনোরকমে পুরানো পেশা টিকিয়ে রাখিছি।’

বাওয়ালিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে প্রতি কুইন্টাল গোলপাতা আহরণে রাজস্ব ছিল ২৫ টাকা। এবার তা বাড়িয়ে ৬০ টাকা করা হয়েছে। এরপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট। এই হিসাবে বড় একটি নৌকার পাস পেতে ১১ হাজার ১৯৩ টাকা রাজস্ব দিতে হয়েছে। শ্রমিকের খরচও অনেক বেড়েছে। আগে সাত থেকে আট হাজার টাকা মাসিক মজুরিতে একজন শ্রমিক পাওয়া যেত। এবার সেখানে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা লেগেছে। সব মিলিয়ে এক নৌকা গোলপাতা আনতে প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ হয়েছে।

৪ নম্বর কয়রা গ্রামের বাওয়ালি নূর ইসলাম বলেন, পেশা টিকিয়ে রাখতে এখনো বনে যাচ্ছেন তিনি। কিন্তু সুন্দরবন থেকে গোলপাতা কেটে এনে খরচই ওঠে না। বাজারে গোলপাতার চেয়ে এখন টিনের প্রচলন বেশি। এ কারণে অনেকেই বাওয়ালি পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন।

খুলনা রেঞ্জের গোলপাতা আহরণের সহকারী কূপ (জোন) কর্মকর্তা মো. তানজিলুর রহমান বলেন, গোলপাতা আহরণে বন বিভাগের শর্ত ছিল ৫০০ মণের বেশি ধারণক্ষমতার নৌকা অনুমতি পাবে না। এ ছাড়া গোলপাতা আহরণের নির্ধারিত সময়ের অতিরিক্ত বনে অবস্থান করা যাবে না, গোলপাতার ঝাড়ের মাইজপাতা ও ঠেকপাতা কোনোভাবেই কাটা যাবে না। বন বিভাগের কঠোর নজরদারির কারণে সব নিয়ম মেনে গোলপাতা কেটে বাড়ি ফিরেছেন বাওয়ালিরা।

সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, এবার গোলপাতা আহরণ মৌসুম কোনো অভিযোগ ছাড়াই শেষ হয়েছে। প্রতিবছর নিয়মমাফিক গোলপাতা সংগ্রহ করলে সুন্দরবনে গোলপাতার গাছের পরিমাণ বেড়ে যাবে।