এক দশক ধরে ছাত্রলীগ নেতা সজলের কাছে জিম্মি বগুড়া আইএইচটির শিক্ষার্থীরা

বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সজল কুমার ঘোষ
ছবি: সংগৃহীত

সজল কুমার ঘোষ শিক্ষার্থী নন। অন্য কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও তাঁর ছাত্রত্ব নেই। তিনি বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। শুধু দলীয় প্রভাব খাটিয়ে এক দশক ধরে বগুড়ার ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজির (আইএইচটি) আবাসিক হোস্টেলের একটি কক্ষ দখল করে বসবাস করছেন। তাঁর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

সজল কুমার ঘোষের গ্রেপ্তারের দাবিতে গতকাল বুধবার দ্বিতীয় দিনের মতো ক্লাস বর্জন করে প্রশাসন ভবনে তালা ঝুলিয়ে শহরের সাতমাথা-বনানী সড়ক অবরোধ করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। দুপুর পর্যন্ত বিক্ষোভের পর শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। এর আগে আইএইচটির শিক্ষার্থীরা গত মঙ্গলবার বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্যাম্পাসের সামনে সাতমাথা-বনানী সড়ক অবরোধ করে লাঠি হাতে বিক্ষোভ মিছিল করেন।

শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের মুখে গা ঢাকা দিয়েছেন অভিযুক্ত সজল কুমার ঘোষ। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা, অস্ত্র আইনসহ একাধিক মামলা আছে। সজলের বিরুদ্ধে আইএইচটির শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে হোস্টেলের ডাইনিং নিয়ন্ত্রণ করে প্রতি মাসে লাখ টাকার বাণিজ্য, হোস্টেলে সিট বাণিজ্য, ব্যবহারিক ও মৌখিক পরীক্ষায় পাস করে দেওয়ার কথা বলে বাণিজ্য, ইন্টার্নশিপের নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি, প্রতিদিন ‘হাজিরা’ প্রথার নামে শিক্ষার্থীদের শারীরিকভাবে নির্যাতন, শিক্ষাসফরের নামে ৭০০ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে তোলা প্রায় ৮ লাখ টাকা আত্মসাৎ, হোস্টেলকক্ষে মদের আসর বসানোসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

কে এই সজল ঘোষ

সাধারণ শিক্ষার্থী ও জেলা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সজল কুমার ঘোষের বাড়ি পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার দিলপাশায়। প্রায় এক যুগ আগে বগুড়ায় আসেন। নিজেকে একসময় একটি বেসরকারি রোগনির্ণয়কেন্দ্রের রেডিওলজিস্ট হিসেবে পরিচয় দিতেন। ছাত্রলীগের প্রভাব খাটিয়ে ২০১৬ সালের দিকে বগুড়ার আইএইচটির আবাসিক হোস্টেলে একটি কক্ষ দখল করে আস্তানা গাড়েন। ওই বছর রনি নামের এক শিক্ষার্থীকে ছুরিকাহত করে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নাইমুর রাজ্জাকের সঙ্গে সখ্যর সুবাদে ২০১৬ সালে জেলা ছাত্রলীগে সাংগঠনিক সম্পাদক পদ পেয়ে যান। এরপর ছাত্রলীগের প্রভাব খাটিয়ে আইএইচটি ক্যাম্পাসে ‘নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা’ করেন। আইএইচটি ছাত্রাবাসের ২১৮ নম্বর কক্ষে নিয়মিত বহিরাগতদের নিয়ে মাদকের আড্ডা বসানোর অভিযোগও আছে তাঁর বিরুদ্ধে।

আরও পড়ুন

ফিজিওথেরাপি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মাহফুজুল ইসলাম অভিযোগ করেন, ছাত্রাবাসে ১৫০ জন আবাসিক শিক্ষার্থী থাকেন। তাঁদের কাছ থেকে প্রতি মাসে ডাইনিংয়ের খাবার বাবদ ১ হাজার ১০০ টাকা হিসাবে ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা তোলেন সজল কুমার ঘোষ। তিন বেলা উন্নত খাবার সরবরাহের কথা থাকলেও ১৫০ শিক্ষার্থীর জন্য শুধু হলুদ দিয়ে চার কেজি চালের খিচুড়ি রান্না করেন। এসব খিচুড়ি মুখে দিতে পারেন না শিক্ষার্থীরা। সকালে অধিকাংশ শিক্ষার্থী বাইরে নাশতা সারেন। অন্য দুই বেলায়ও নিম্নমানের খাবার সরবরাহ করে সিংহভাগ টাকা পকেটে ভরেন সজল ঘোষ।

ছাত্রলীগের সাবেক নেতা সজল কুমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ কর্মসূচি। গতকাল বুধবার দুপুরে বগুড়ার ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি চত্বরে
ছবি: প্রথম আলো

মাহমুদুল ইসলাম নামের তৃতীয় বর্ষের আরেক শিক্ষার্থীর অভিযোগ, পরীক্ষায় ফরম পূরণের সময় ক্লাসে অনুপস্থিতির অজুহাত তুলে সজল ঘোষ প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনকে ম্যানেজ করে শিক্ষার্থীদের ফরম পূরণ আটকে দিতেন। এরপর জনপ্রতি ১০ হাজার টাকা চাঁদা নিয়ে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ করে দিতেন।

এ ছাড়া ইন্টার্নশিপ করতে সজল ঘোষকে ৩ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। সম্প্রতি তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠানের জন্য জনপ্রতি ৫০০ টাকা হিসেবে সাড়ে চার লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়। লাখখানেক টাকা খরচ করে এ টাকার পুরোটাই আত্মসাৎ করেন সজল। এ ছাড়া শিক্ষাসফরের জন্য প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা চাঁদা তোলেন সজল ঘোষ। ৭০০ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা চাঁদা উঠলেও শিক্ষাসফরে নিয়ে যাননি তিনি।

মো. রিফাত নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, প্রতিরাতেই সজলের দখলে থাকা কক্ষে মাদকের আসর বসে। প্রতিদিন ক্লাস শেষে ক্যাম্পাসের তেঁতুলতলায় তিনি চেয়ার নিয়ে বসতেন। ক্লাস শেষে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে তাঁর সঙ্গে দেখা করে সালাম দিতে হতো। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে শারীরিক নির্যাতন করা হতো। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের কোনো কর্মসূচি থাকলেই হোস্টেলের শিক্ষার্থীদের মিছিলে ভাড়া দিয়ে নেতাদের কাছ থেকে চাঁদা নিতেন সজল কুমার ঘোষ।

আইএইচটি সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের জন্য ১৯৭৮ সালে দুটি আবাসিক হোস্টেল চালু হয়। এর মধ্যে একটি ছাত্রদের, অন্যটি ছাত্রীদের। প্রথমে এটি মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুলের (ম্যাটস) শিক্ষার্থীরা ব্যবহার করতেন। সে সময় ম্যাটসের কার্যক্রমের জন্য এখানে কিছু ভবন নির্মাণ করা হয়। ১৯৯২ সালে থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত এটি শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের ভবন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পরে এই মেডিকেল কলেজ নতুন ভবনে স্থানান্তর হয়। এরপর এখানে আইএসটির কার্যক্রম শুরু হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চারতলা এই হলে মোট ৭২টি কক্ষ রয়েছে। প্রতিটি কক্ষে দুজন শিক্ষার্থী থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। এ হিসাবে মোট ১৪৪ শিক্ষার্থী থাকার জায়গা রয়েছে এই হলে। হলের সিট বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন সজল কুমার ঘোষ। একটি সিটের জন্য এককালীন ৫-১০ হাজার টাকা নিতেন সজল। তাঁর কথামতো না চললেই শিক্ষার্থীদের তিনি মারধর করেন। ২০১৮ সালের দিকে সজল ঘোষের অত্যাচারে হোস্টেল ছাড়তে শুরু করেন শিক্ষার্থীরা।

ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে বগুড়ার ইনস্টিটিউট অব হেলথ্ টেকনোলজির শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ করেন । গত মঙ্গলবার বিকেলে ইনস্টিটিউটের সামনে শেরপুর সড়কে
ছবি: প্রথম আলো

একাধিক শিক্ষার্থী জানান, দলীয় কোনো মিছিলে না গেলে মারধর করা হয় শিক্ষার্থীদের। হুমকি দেওয়া হয়। সজলের বন্ধুবান্ধব ছাড়া ক্যাম্পাসের মাঠে কেউ খেলাধুলাও করতে পারেন না। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বেনামে চাঁদা নেন সজল। আইএসটিতে ভর্তি হওয়ার সময় শিক্ষার্থীদের হল বরাদ্দ দেওয়া হয়। হলে থাকতে হলে প্রত্যেক ছাত্রকে ৩ বছরের জন্য এককালীন ১২ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয়। সজলকে এর বাইরে ১০ হাজার টাকা দিতে হয়।

প্রতিবাদের শুরু যেভাবে

আমিনুল ইসলাম নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, গত মঙ্গলবার দুপুরে তিনি ছাত্র হোস্টেলের দুপুরের খাবারের জন্য বাজার করতে গিয়ে ২৫০ গ্রাম পেঁয়াজ বেশি কেনেন। এ অপরাধে তাঁকে মারধর করেন সজল ঘোষ। এরপরেই শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে সড়ক অবরোধ করেন।

আইএইচটির তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মুশফিকুর রহিম ক্ষোভ নিয়ে বলেন, ‘এমন কেউ নেই যে সজলের মারধরের শিকার হয়নি। চুন থেকে পান খসলেই মারেন। আমাকেও মারধর করেছেন তিনি।’ মুশফিকুর আরও বলেন, ‘পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেওয়ার কথা বলে সজল ঘোষ আমার থেকে ৩০ হাজার টাকা চান। আমি সেটি দিতে না পারায় আমাকে মৌখিক পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেন।’

সজলের নির্যাতনের শিকার রেডিওলজি বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী বাছেদ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘সপ্তাহ দুয়েক আগে ছাত্রলীগের মিছিলে যেতে দেরি হওয়ায় আমাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করেন সজল ঘোষ। আইএইচটি প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদেই তিনি এত দিন এসব অপকর্ম করে গেছেন। তাঁর ভয়ে তটস্থ হয়ে আইএইচটি প্রশাসন “অতিথি শিক্ষক” হিসেবেও নিয়োগ দিয়েছেন। অথচ তাঁর সনদ ভুয়া।’

আইএইচটি প্রশাসনের ছত্রছায়ায় সজল বেপরোয়া হয়ে ওঠেন বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। গতকাল দুপুরে বগুড়ার ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি চত্বরে
ছবি: প্রথম আলো

জানতে চাইলে আইএইচটির হোস্টেলের সহকারী মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘সজল কখনোই আইএইচটির শিক্ষার্থী ছিল না। কীভাবে হোস্টেলে এত দিন ছিল, সেটা আমার জানা নেই।’

আইএইচটির অধ্যক্ষ আমায়াত-উল-হাসিন বলেন, ‘সজল ঘোষ নামে বহিরাগত কোনো ব্যক্তি হোস্টেলে অবস্থানের বিষয়টি এত দিন জানা ছিল না। সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের বিষয়টিও জানা নেই। শিক্ষাসফরের নামে চাঁদা তোলার বিষয়ে অবগত নই। তাঁর বিরুদ্ধে এত দিন কেউ লিখিত অভিযোগ দেননি। এখন অভিযোগ পেয়েছি, ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ সজলকে অতিথি শিক্ষক করা হয়েছিল কি না, প্রশ্ন করলে অধ্যক্ষ বিষয়টি এড়িয়ে জানান।

বগুড়া সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরাফত ইসলাম বলেন, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কারও কাছে জিম্মি হয়ে থাকতে পারে না। আইএইচটির শিক্ষার্থীদের অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে কাউকে চাঁদাবাজি করতে দেওয়া হবে না।

সজল কুমার ঘোষ মুঠোফোন বন্ধ রেখে আত্মগোপন করায় অভিযোগগুলোর বিষয়ে তাঁর বক্তব্য জানা যায়নি। তবে বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নাইমুর রাজ্জাক দাবি করেন, ‘সজল কুমার ঘোষ একসময় আইএইচটির শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি পাবনা জেলার বাসিন্দা হলেও বগুড়ায় বসবাস করায় জেলা ছাত্রলীগে সাংগঠনিক সম্পাদক পদ দেওয়া হয়েছিল।’

বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি সজীব কুমার সাহা বলেন, সজল কুমার বর্তমানে সংগঠনের কোনো পদে নেই। এ কারণে তাঁর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণেরও সুযোগ নেই।