যেভাবে ২০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ঠিকঠিক ঘরে ফিরল কবুতরের দল

ফেনী থেকে মৌলভীবাজারের বড়লেখায় ফেরার পথে কবুতরের ঝাঁকছবি: প্রথম আলো

কবুতরের খাঁচা খুলে দেওয়া হয়েছে ফেনীতে। সেখান থেকে খোলা আকাশ দিয়ে তাদের ফিরতে হবে মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলায় নিজের ডেরায়। যে আগে ফিরবে, তার মালিকের জন্য আছে পুরস্কার। পুরস্কার নিয়ে হয়তো ভাবার সুযোগ নেই কবুতরের। কিন্তু ফেনী থেকে এতটা পথ চিনে ঠিকই নিজেদের গন্তব্যে ফিরেছে কবুতরের দল।

শনিবার বড়লেখা রেসিং পিজিয়ন ক্লাব কবুতর নিয়ে এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। সবাই মিলে আনন্দ করতেই এমন আয়োজন। কবুতর দলের কেউ আগে, কেউ পরে বাড়ি ফিরলেও তারা সবাই পথ চিনে নিয়েছে। প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে যে কবুতরটি, সেটি সোয়া ২ ঘণ্টায় ২০৫ কিলোমিটার আকাশপথ পাড়ি দিয়ে বাড়ি ফিরেছে।

আরও পড়ুন

বড়লেখা রেসিং পিজিয়ন ক্লাব ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বড়লেখার কয়েকজন তরুণ শখের বশে কবুতর পালতে গিয়ে ২০১৮ সালে গঠন করেন বড়লেখা রেসিং পিজিয়ন ক্লাব। সেই থেকে ক্লাবের আয়োজনে কবুতরের এমন উড়ার প্রতিযোগিতা হচ্ছে। ক্লাব থেকে বছরে তিন-চারবার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এবার চূড়ান্ত প্রতিযোগিতার আগে দুই দফা কম দূরত্বে উড়ার প্রতিযোগিতা হয়েছে। গত ১৯ ডিসেম্বর প্রথম প্রতিযোগিতা হয়। বড়লেখা থেকে হবিগঞ্জের শাহজীবাজারের দূরত্ব ১০০ কিলোমিটার। সেখান থেকে ছাড়া হয়েছিল কবুতরের ঝাঁক। দ্বিতীয় প্রতিযোগিতা হয়েছে গত ৪ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থেকে। কসবা থেকে বড়লেখার দূরত্ব ১৫০ কিলোমিটার। দুই দফা প্রতিযোগিতার মহড়া শেষে প্রস্তুতি নেওয়া হয় চূড়ান্ত প্রতিযোগিতার। আবহাওয়া ভালো থাকায় গত শনিবার হয়েছে এবারের চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা।

কবুতরের এই ঝাঁকটি পাড়ি দিয়েছে প্রায় ২০৫ কিলোমিটার আকাশপথ
ছবি: প্রথম আলো

আয়োজকেরা বলেন, ফেনী থেকে কবুতরের ঝাঁককে আকাশে উড়ানো হয়েছে। শনিবার সকাল সোয়া নয়টায় খাঁচা খুলে দেওয়া হয়। ফেনী থেকে আকাশ পথে বড়লেখার দূরত্ব ২০৫ কিলোমিটার। ২ ঘণ্টা ১৫ মিনিটে আকাশ পথ পাড়ি দিয়ে প্রথম কবুতরটি বড়লেখার নিজের ডেরায় ঠিকঠাক মতো পৌঁছায়। এরপর একে একে সবাই ফেরে নিজেদের ঘরে। উচ্ছ্বাস আর আনন্দে ভাসেন অংশগ্রহণকারীরা। প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বে প্রথম হয়েছে আনিসুল হকের কবুতর। দ্বিতীয় দেলওয়ার হোসেনের কবুতর এবং তৃতীয় মাসুম মোহাম্মদের কবুতর। প্রতিযোগিতার প্রথম পুরস্কার ১ লাখ টাকা, দ্বিতীয় পুরস্কার ৫০ হাজার টাকা এবং তৃতীয় পুরস্কার ৩০ হাজার টাকা। সঙ্গে আছে সব বিজয়ীর জন্য ট্রফি। প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীর জন্যও আছে ক্রেস্ট। প্রতিযোগিতায় ২৫ জন সদস্যের ১৫০টি কবুতর অংশ নিয়েছে। প্রত্যেক সদস্যের নিবন্ধন ফি ছিল পাঁচ হাজার টাকা।

আরও পড়ুন

আয়োজকেরা বলেন, কবুতরের আকাশ যতটা মুক্ত ও বাধাহীন মনে হয়, ততটা নয়। পথে ঝুঁকি আছে, পথ হারানোর আশঙ্কা আছে। পথে পথে ওত পেতে থাকে বাজ পাখি। লক্ষ্যের দিকে ছুটে চলা কবুতরকে বাজ পাখি বারবার আক্রমণ করে। এতে আক্রান্ত কবুতর দিশাহারা হয়ে পথ হারিয়ে ফেলে। আহত হয়ে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়ে। তারা আর চেনা পথ ধরে ফিরতে পারে না। এবার ১০০ কিলোমিটারে ১০টি এবং ১৫০ কিলোমিটারে ১৫টি কবুতর পথ হারিয়েছে। তবে এই কবুতরদের বাড়ি চেনাতেও অনেক শ্রম দিতে হয় মালিককে। রেসার কবুতরের মালিক নিজেই বাড়ির আশপাশকে চেনানোর জন্য নানারকম প্রশিক্ষণ দেন। শুরুতে ৫ কিলোমিটার দূরত্বে নিয়ে কবুতরকে ছেড়ে দেন। দেখেন ঠিকঠাক মতো কবুতরটি নিজের ডেরায় ফিরতে পারে কিনা। এরপর একইভাবে ১০ কিলোমিটার, ২০ কিলোমিটার এবং ৩০ কিলোমিটার দূরত্বের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

কবুতর এই পথটুকু চিনে গেলে রেসিং পিজিয়ন ক্লাব বড়লেখা থেকে ৫০ ও ৭০ কিলোমিটার দূরত্বে নিয়ে কবুতরকে বাড়ি ফেরার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এভাবে বাড়ি ফেরার পথ চেনা হয়ে গেলে শুরু হয় প্রতিযোগিতার আয়োজন। বিজয়ী কবুতরেরও আছে আলাদা কদর। চূড়ান্ত প্রতিযোগিতার সেরা ১০টিকে তোলা হয় নিলামে। স্বাভাবিকভাবে যে কবুতরের মূল্য ১০ হাজার টাকা, নিলামে সেটি ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হয়।

বড়লেখা রেসিং পিজিয়ন ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ক্লাবের সদস্যরা শৌখিন ও বাণিজ্যিকভাবে কবুতর লালন-পালন করেন। তাঁদের মধ্যে বেশ কজন প্রবাসীও আছেন। কবুতর নিয়ে এ রকম প্রতিযোগিতার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সবাই মিলে আনন্দ করা। চ্যাম্পিয়ন কবুতরগুলো বেশ দামে বিক্রি হয়ে থাকে। শীতের মৌসুমে এই রেসের আয়োজন করা হয়।’