এক বাড়িতে শত প্রজাতির গাছ

শওকত আলী প্রায় ৫০ বছর ধরে তিনি এসব গাছ সংগ্রহ করেছেন। বাড়িতে গাছ লাগানোর কারণে পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার।

গাছের পরিচর্যা করছেন শওকত মাস্টার। গোবিন্দগঞ্জের শীতল গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

সন্তানের মতো গাছকেও ভালোবাসেন তিনি। প্রায় সারা জীবন কাটিয়েছেন গাছের সঙ্গে। যেখানেই বিরল প্রজাতির গাছ পেয়েছেন, সংগ্রহ করে বাড়িতে এনে রোপণ করেছেন। তাঁর বাড়ির আঙিনা, উঠান কিংবা পুকুরের পাড় সবখানেই শুধু গাছ আর গাছ। তাঁর সংগ্রহে আছে গোলাপজান, জাফরানসহ শতাধিক প্রজাতির গাছ। প্রায় ৫০ বছর ধরে তিনি এসব গাছ সংগ্রহ করেছেন।

গাছপাগল এই মানুষের নাম মো. শওকত আলী (৮৫)। স্থানীয় লোকজনের কাছে তিনি ‘শওকত মাস্টার’ হিসেবে পরিচিত। তাঁর বাড়ি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার নাকাই ইউনিয়নের শীতল গ্রামে। বসতভিটায় গাছ লাগানোর জন্য তাঁকে ২০১২ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার দেওয়া হয়। তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দেন। এ ছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নানান পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।

সম্প্রতি তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, সবুজ প্রকৃতিতে ঘেরা বসতভিটার আঙিনা, উঠান, আনাচেকানাচে বিভিন্ন জাতের গাছ। বৃদ্ধ বয়সেও তিনি গাছের পরিচর্যা করছেন। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে শওকত আলী বললেন, ছেলেমেয়েদের মতোই তিনি গাছ ভালোবাসেন। প্রায় সারা জীবন গাছের সঙ্গেই কাটিয়েছেন। বসতভিটাকে কৃষি খামারে পরিণত করার পরিকল্পনা আছে তাঁর। বেঁচে থাকতে এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে না পারলে সন্তানদের নির্দেশ দিয়ে যাবেন বলে জানান তিনি।

স্ত্রী আমিনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি গাছ ছাড়া আর কিছুই বোঝেন না। বাজার খরচের টাকা বাঁচিয়ে তিনি গাছ কিনে নিয়ে বাড়ি ফেরেন। নাকাই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য মেসবাউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিরল জাতের গাছ লাগিয়ে শওকত মাস্টার তাঁদের গ্রামের নাম দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছেন।

৫০ শতকের বসতভিটায় শতাধিক প্রজাতির গাছ আছে। ফুলের গাছের মধ্যে ক্যামেলিয়া, টিউলিপ, মে, ইফোর বিয়া, জবা, গোলাপ, বেলি, জুই, গ্লাডিওলাস, ব্লিডিং হার্ট, রঙ্গন, ইকজুরা উল্লেখযোগ্য। আর ফলের মধ্যে আছে খেজুর, ড্রাগন, অ্যাভোকাডো, করমচা, নাসপাতি, শরিফা, সফেদা, গোলাপজান, জাফরান, আম, জাম, লিচু, জামরুল, পেয়ারা, কমলা, মালটা, ফলসা, কামরাঙা, অরবরই, নারিকেল, সুপারি ইত্যাদি। ঔষধি গাছের মধ্যে আমলকী, হরীতকী, বহেড়া, অর্জুন, তুলসী, চিরতা, ভৃঙ্গরাজ উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া বিভিন্ন জাতের বাদাম, লং, এলাচ, পান মসলা, কালিজিরা, তেজপাতা, দারুচিনি, আলুবোখারা গাছও আছে তাঁর সংগ্রহে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সৈয়দ রেজা-ই-মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, শওকত আলীর বাড়িতে তিনি একাধিকবার গিয়েছেন। তাঁর বসতভিটায় শতাধিক বিরল প্রজাতির গাছ আছে। এ ছাড়া অন্যান্য প্রজাতির গাছও আছে। নিজের চেষ্টায় তিনি সেগুলো সংগ্রহ করেছেন। কৃষি বিভাগ থেকেও তাঁকে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। তাঁর উদ্যোগ কৃষিক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

শওকত আলীর ছেলে পাপুল মিয়া বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই দেখছি, বাবা একজন বৃক্ষপ্রেমী মানুষ। এখন বয়সের ভারে ঠিকমতো গাছের পরিচর্যা করতে পারেন না। তারপরও বসে থাকেন না। সকালে ঘুম থেকে উঠেই গাছের দেখাশোনা শুরু করেন।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. বেলাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, শওকত মাস্টার কৃষিক্ষেত্রে অনন্য অবদান রেখেছেন। তিনি জেলার কৃষকদের মধ্যে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন। কৃষি বিভাগ থেকে তাঁকে সব সময় অনুপ্রেরণা দেওয়া হচ্ছে।

কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়া শওকত আলী বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। ১৯৬৯ সালে স্নাতক পাস করে পরের বছর তিনি ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। ২০০৭ সালে অবসরে যান। পাশাপাশি হোমিও চিকিৎসক হিসেবে এলাকায় তাঁর খ্যাতি আছে।