বনবিট কর্মকর্তার মাথার ওপর ট্রাকের চাকা তুলে দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়

ট্রাক চাপায় খুনের শিকার বন বিট কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামানছবি-সংগৃহীত

কক্সবাজারের উখিয়ায় বনবিট কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামানকে (৩০) ডাম্পারট্রাকচাপায় হত্যার ঘটনায় থানায় ১০ জন পাহাড়খেকো ও বালু ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। পুলিশ আজ সোমবার সকালে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে।

গতকাল রোববার রাতে উখিয়া থানায় উখিয়া বন রেঞ্জ কর্মকর্তা গাজী মো. শফিউল আলম বাদী হয়ে এ মামলা করেন। মামলায় আরও চার থেকে পাঁচজনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। মামলার বাদী গাজী মো. শফিউল আলম প্রথম আলোকে বলেন, পরিকল্পিতভাবে বিট কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি অত্যন্ত সাহসী ও দায়িত্বের প্রতি অবিচল ছিলেন। গত মার্চে তিনি পাহাড়খেকো ও বালু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা করেছিলেন। এতে ক্ষুব্ধ হন অনেকে। গতকাল রাতে ঘটনার সময় প্রথমে বালুবাহী ডাম্পারট্রাক দিয়ে বিট কর্মকর্তার মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেওয়া হয়। সাজ্জাদুজ্জামান মোটরসাইকেল থেকে রাস্তায় ছিটকে পড়লে মাথার ওপর ট্রাকের চাকা তুলে দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।

নিহত সাজ্জাদুজ্জামান কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের উখিয়া রেঞ্জের দোছড়ি বনবিটের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি মুন্সিগঞ্জ জেলার গজারিয়া উপজেলার ভবেরচর গ্রামের মোহাম্মদ শাহজাহানের ছেলে।

মামলার আসামিরা হলেন রাজাপালং ইউনিয়নের পশ্চিম হরিণমারার মো. কাশেমের ছেলে ডাম্পারচালক বাপ্পি (২৩), একই গ্রামের সুলতান আহমদের ছেলে ডাম্পারমালিক ছৈয়দ আলম (৪০), তাঁর ছেলে মো. তারেক (২০), তুতুরবিল গ্রামের নুরুল আলমের ছেলে হেলাল উদ্দিন (২৭), হরিণমারার আবদুল আজিজের ছেলে ছৈয়দ করিম (৩৫) ও আনোয়ার ইসলাম (৩৭), আবদুর রহিমের ছেলে শাহ আলম (৩৫), হিজলিয়া গ্রামের ঠান্ডা মিয়ার ছেলে মো. বাবুল (৫০) ও ফরিদ আলমের ছেলে মো. রুবেল (২৪) এবং বাগানপাড়ার শাহ আলমের ছেলে কামাল উদ্দিন ড্রাইভার (৩৯)। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও চার থেকে পাঁচজনকে আসামি করা হয়েছে।

মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামিরা পাহাড় কাটার সক্রিয় সদস্য। হরিণমারা এলাকার সরকারি পাহাড় কেটে মাটি বিক্রি করেন তাঁরা। নিহত সাজ্জাদুজ্জামান একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করে ডাম্পারট্রাক জব্দ করেন এবং আসামিদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করেন। যার ফলে আসামিরা ক্ষুব্ধ হয়ে এমন কাণ্ড ঘটিয়েছেন।

এজাহারে আরও বলা হয়, গতকাল দিবাগত রাত সোয়া তিনটার দিকে টহল দলের সদস্য আলী আহমদকে সঙ্গে নিয়ে মোটরসাইকেলে ঘটনাস্থল রাজাপালং ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যম হরিণমারার লালুর বাপেরটেক এলাকায় যান সাজ্জাদ। ইটের রাস্তায় পৌঁছে তিনি দেখতে পান আসামিরা কয়েকটি ট্রাকযোগে সরকারি পাহাড় কাটার মাটি নিয়ে যাচ্ছেন। তখন ট্রাক থামাতে বললে আসামিরা বিট কর্মকর্তার দিকে তেড়ে আসেন এবং অশ্লীল ভাষায় গালাগাল শুরু করেন। একপর্যায়ে ডাম্পারচালক বাপ্পি ও ছৈয়দ আলম ডাম্পার দিয়ে সাজ্জাদের মোটরসাইকেলে সজোরে ধাক্কা মারেন।

তাতে মোটরসাইকেলের পেছনে বসা আলী আহমদ মাটিতে ছিটকে পড়েন আর সাজ্জাদ ছিটকে পড়েন ইটের রাস্তার ওপর। তখন চালক বাপ্পি সাজ্জাদের শরীরের ওপর ডাম্পারট্রাক তুলে দেন। এ সময় ট্রাকচাপায় সাজ্জাদের মাথা পিষ্ট হয়। ঘটনাস্থলে সাজ্জাদের মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়ে যান আসামিরা। পরে পুলিশ পৌঁছে তাঁর মরদেহ উদ্ধার করে।

উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শামীম হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিহত সাজ্জাদুজ্জামানের ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল দুপুরে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর ওই রাতে থানায় সরকারি কাজে বাধা ও পরিকল্পিতভাবে হত্যার ঘটনায় এজাহারনামীয় ১০ জনসহ অজ্ঞাতনামা আরও ৪ থেকে ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। আজ পুলিশ মামলার ৫ নম্বর আসামি ছৈয়দ করিমকে গ্রেপ্তার করেছে। অন্য আসামিদের ধরতে এলাকায় অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। ডাম্পারট্রাকটি জব্দ করা হয়েছে।

এ ঘটনায় আহত বন বিভাগের টহল দলের সদস্য আলী আহমদ উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন। তাঁর বাড়ি টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ঝিমংখালী গ্রামে। বাবার নাম আবুল মনজুর।

বিট কর্মকর্তার মৃত্যুতে বনকর্মীদের মাঝে শোকের ছায়া নেমে এসেছে জানিয়ে উখিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা গাজী মো. শফিউল আলম বলেন, পাহাড় কাটার খবর পেলেই সাজ্জাদ ঘটনাস্থলে ছুটে যেতেন। বনাঞ্চল রক্ষায় জীবনবাজি রাখছেন। অত্যন্ত সাহসী ও দায়িত্ব পালনে অবিচল ছিলেন। অথচ এমন একজন তরতাজা মানুষকে গাড়িচাপা দিয়ে হত্যা করা হলো। ডাম্পারচালক ও মালিক পরিকল্পিতভাবে কাজটি করেছেন।

আজ সকাল আটটায় সাজ্জাদের মরদেহ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছেছে জানিয়ে রেঞ্জ কর্মকর্তা শফিউল বলেন, সংসারে তাঁর ১১ মাসের একটি কন্যাসন্তান রয়েছে। স্ত্রী থাকতেন গ্রামের বাড়িতে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি বন বিভাগে যোগদান করেন। এই ঈদের ছুটিতে তাঁর বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল। মেয়ের জন্য কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরবেন, এমন পরিকল্পনা ছিল। অথচ লাশ হয়ে বাড়ি ফিরতে হলো তাঁকে।