ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে নওগাঁর পশুর হাটে চলছে ইচ্ছেমতো খাজনা আদায়

নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার ছাতড়া পশুর হাট। এই হাটে ইজারাদারের অতিরিক্ত খাজনা আদায় নিয়ে বিপাকে পড়েছেন ক্রেতা–বিক্রেতারা। সোমবার বিকেলে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

কোরবানিকে সামনে রেখে নওগাঁর পশুর হাটগুলোতে ইজারাদারেরা ইচ্ছেমতো হাসিল বা খাজনা আদায় করছেন। তাঁরা প্রশাসনের বেঁধে দেওয়া ইজারা শর্ত ও নীতিমালার ধার ধারছেন না। জেলার পশুর হাটগুলো ঘুরে, বিক্রির রসিদ বই দেখে এবং ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা জানা গেছে, গরু-ছাগল বিক্রিতে বর্তমানে নির্ধারিত খাজনার চেয়ে দ্বিগুণ পর্যন্ত খাজনা আদায় করা হচ্ছে। কেবল তা-ই নয়, নীতিমালায় শুধু ক্রেতার কাছ থেকে খাজনা আদায়ের কথা থাকলেও বিক্রেতার কাছ থেকেও খাজনা আদায় করা হচ্ছে।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, নওগাঁয় ছোট-বড় ১০৪টি হাটবাজার রয়েছে। এর মধ্যে স্থায়ী পশুর হাট রয়েছে ৩৮টি, যেগুলো জেলা প্রশাসন থেকে ইজারা দেওয়া হয়। এসব হাটে গবাদিপশুসহ ১২৫ ধরনের দ্রব্য কেনাবেচার জন্য খাজনা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে প্রতিটি গরু ও মহিষের জন্য ৫০০ টাকা এবং প্রতিটি ছাগল ও ভেড়ার জন্য ২০০ টাকা খাজনা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া গবাদিপশুর জন্য শুধু ক্রেতারাই খাজনা দেবেন বলা আছে।

পশুর হাট ইজারা নিয়ে ঈদুল আজহার সময় খাজনা আদায় করে একটু লাভ হয়। তা ছাড়া সারা বছর তেমন গরু-ছাগল বিক্রি হয় না। প্রায় ৭ কোটি টাকায় এই হাট ইজারা নেওয়া হয়েছে। এই সময়ে একটু লাভ করতে না পারলে লোকসান গুনতে হবে।
সুজন হোসেন, নওগাঁর চৌবাড়িয়া হাটের ইজারাদার

নওগাঁর অন্যতম বড় পশুর হাট মান্দা উপজেলার চৌবাড়িয়া হাট। সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার এই হাটে পশু কেনাবেচা হয়ে থাকে। গত শুক্রবার এই হাটে সরেজমিনে দেখা যায়, হাটের কোথাও খাজনা আদায়সংক্রান্ত কোনো নিয়মাবলি বা তালিকা টাঙানো নেই। এতে সাধারণ ক্রেতা-বিক্রেতারা সরকার নির্ধারিত খাজনার পরিমাণ সম্পর্কে জানতে পারছেন না। প্রতিটি গরুর জন্য ৫০০ টাকা করে খাজনা আদায় করার কথা থাকলেও কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ৯০০ টাকা করে খাজনা আদায় করা হচ্ছে। এর মধ্যে ক্রেতার কাছ থেকে ৮০০ টাকা এবং বিক্রেতার কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে ১০০ টাকা করে। ছাগলপ্রতি ২০০ টাকা করে খাজনা নির্ধারণ করা থাকলেও আদায় করা হচ্ছে ৪০০ টাকা করে।

নওগাঁর মান্দা উপজেলার চৌবাড়িয়া হাটে গরু বিক্রির রসিদ দেওয়া হলেও সেখানে খাজনার পরিমাণ লেখা নেই। গত শুক্রবার বিকেলে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

এই হাটে গরু কিনতে এসেছিলেন দুলাল হোসেন। কথা বলে জানা যায়, তিনি রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার হরিদাগঞ্জ থেকে এসেছেন। অনেকক্ষণ ঘুরে তিনি কোরবানির জন্য একটি গরু পছন্দ করেন। বিক্রেতা ফইমুদ্দিনের সঙ্গে দরদাম করে ৮৫ হাজার টাকায় গরুটি কিনে নেন। গরু বিক্রির ছাড়পত্র নেওয়ার জন্য পাশেই টেবিল-চেয়ার নিয়ে বসে ছিলেন ইজারাদারের প্রতিনিধি রফিকুল ইসলাম। তাঁর কাছে যান ওই গরুর ক্রেতা-বিক্রেতা। ইজারাদারের প্রতিনিধি ক্রেতার কাছ থেকে ৮০০ টাকা এবং বিক্রেতার কাছ থেকে ১০০ টাকা খাজনা দাবি করেন। এ নিয়ে তাঁদের বাগ্‌বিতণ্ডা হয়। তবে শেষমেশ ক্রেতা দুলাল হোসেনকে ৮০০ টাকা ও বিক্রেতা ফইমুদ্দিনকে ১০০ টাকা খাজনা দিয়েই হাট ছাড়তে হয়।

দুলাল হোসেন বলেন, তাঁর কাছ থেকে ৮০০ টাকা ও বিক্রেতার কাছ থেকে ১০০ টাকা খাজনা আদায় করলেও রসিদে (ছাড়পত্র) খাজনার ঘরে কোনো টাকার অঙ্ক লেখা নেই। তিনি খাজনার পরিমাণ লেখার জন্য জোর করলেও ‘বই (রসিদ) লেখক’ সেটা লিখতে রাজি হননি।

কোরবানির সময় এসব ধরে কোনো লাভ নেই। শুধু এই হাটে নয়, কমবেশি সব হাটেই এখন একটু বেশি টাকা আদায় করা হচ্ছে। যে টাকা দিয়ে হাট ইজারা নেওয়া হয়, কোরবানির সময় একটু বেশি খাজনা আদায় না করলে পোষাবে না।
আনোয়ার হোসেন, নওগাঁর ছাতড়া হাটের ইজারাদার

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইজারাদারের প্রতিনিধি রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি গরুর হাটের একজন বই লেখক। ইজারাদার আমাদের যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন, সেভাবেই আমরা হাসিল করছি। সরকার নির্ধারিত হাসিলের পরিমাণ কত, সেটা ইজারাদারই ভালো বলতে পারবেন।’

যোগাযোগ করা হলে চৌবাড়িয়া হাটের ইজারাদার সুজন হোসেন বলেন, ‘পশুর হাট ইজারা নিয়ে ঈদুল আজহার সময় খাজনা আদায় করে একটু লাভ হয়। তা ছাড়া সারা বছর তেমন গরু-ছাগল বিক্রি হয় না। প্রায় ৭ কোটি টাকায় এই হাট ইজারা নেওয়া হয়েছে। এই সময়ে একটু লাভ করতে না পারলে লোকসান গুনতে হবে।’

নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার ছাতড়া পশুর হাট। সোমবার বিকেলে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

নওগাঁর আরও তিনটি পশুর হাট ঘুরে একই চিত্র দেখা গেছে। জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার ছাতড়া হাট, মহাদেবপুর উপজেলার মাতাজি হাট, পোরশার মশিদপুর হাটসহ ছোট-বড় সব পশুর হাটেই চলছে ইজারাদারের ইচ্ছামাফিক খাজনা আদায়। অধিকাংশ হাটেই খাজনা আদায়-সংক্রান্ত নির্দেশনাবলি টাঙানো হয়নি।
নিয়ামতপুরের ছাতড়া হাটে সপ্তাহের প্রতি সোমবার পশুর হাট বসে। আজ সোমবার ছাতড়া হাটে সরেজমিনে দেখা যায়, গরুপ্রতি ৯০০ টাকা করে খাজনা আদায় করা হচ্ছে। এর মধ্যে ক্রেতার কাছ থেকে ৮০০ টাকা এবং বিক্রেতার কাছ থেকে ১০০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে। ছাগলের ক্ষেত্রে খাজনা আদায় করা হচ্ছে ৪০০ টাকা করে।  

ছাতড়া হাটে গরু বিক্রি করতে এসেছিলেন জিয়ারুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। তিনি নিয়ামতপুরের ভাবিচা ইউনিয়নের ধর্মপুর গ্রামের বাসিন্দা। জানান, তিনি ১৫ বছর ধরে কোরবানির সময় গরু-ছাগল কেনাবেচার ব্যবসা করছেন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে গৃহস্থদের কাছ থেকে দরদাম করে গরু কিনে কোরবানির সময় বিভিন্ন হাটে তুলে একটু লাভ দিয়ে সেগুলো বিক্রি করেন। এত দিন গরু বিক্রির জন্য ক্রেতার কাছ থেকে খাজনা আদায় করা হলেও এবার নওগাঁর হাটগুলোতে বিক্রেতার কাছ থেকেও খাজনা আদায় করছেন ইজারাদারেরা।

নির্ধারিত খাজনার চেয়ে বেশি টাকা আদায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে ছাতড়া হাটের ইজারাদার আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘কোরবানির সময় এসব ধরে কোনো লাভ নেই। শুধু এই হাটে নয়, কমবেশি সব হাটেই এখন একটু বেশি টাকা আদায় করা হচ্ছে। যে টাকা দিয়ে হাট ইজারা নেওয়া হয়, কোরবানির সময় একটু বেশি খাজনা আদায় না করলে পোষাবে না।’

এ বিষয়ে নওগাঁ স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, কোরবানির হাটে পশু কেনাবেচায় অতিরিক্ত খাজনা আদায়ের সুযোগ নেই। পশুর হাটে যাতে অতিরিক্ত খাজনা আদায় না হয়, এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা প্রতিটি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাকে দেওয়া হয়েছে। তাঁদের সার্বক্ষণিক তদারকি ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত খাজনা আদায়ের জন্য কয়েকজন ইজারাদারকে জরিমানাও করা হয়েছে।