প্রায় ৩০ বছর ধরে লোকবাদ্যযন্ত্রের ব্যবসা করছেন গোপাল দাস
ছবি: আনিস মাহমুদ

পুরোনো একটি তবলা মেরামত করছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব গোপাল দাস। সিলেট নগরের শেখঘাট এলাকার একটি ভবনের দ্বিতীয় তলায় তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান—‘মনিকা তবলা’। কিছুটা দূরে তাঁর ছেলে বসে আছেন। পারিবারিক এ ব্যবসার সঙ্গে গোপালের প্রায় ৩০ বছরের সম্পর্ক। এর আগে গোপালের বাবা-চাচারাও একই ব্যবসা করতেন। গোপাল এখন তাঁর দুই ছেলেকে নিয়ে দোকানটি চালান।

মনিকা তবলা নামের এই দোকানে তবলা ছাড়াও কাটি ঢোল, খোল, নালের মতো লোকবাদ্যযন্ত্র পাওয়া যায়। এসব বাদ্যযন্ত্র মেরামতও করা যায় এখানে।

টাঙ্গাইল মির্জাপুরের বাসিন্দা গোপাল দাসের পরিবারে আট সদস্য। বাবা-চাচার হাত ধরে তিনি এ পেশায় এসেছেন। তবে বেশ কয়েক বছর চাকরিও করেছেন তিনি। চাকরির সুবাদে খুলনা, বাগেরহাট, কালীগঞ্জ, যশোর ও সুনামগঞ্জে থেকেছেন। সর্বশেষ সিলেটে এসে পারিবারিক ব্যবসাতেই থিতু হয়েছেন। সুনামগঞ্জে গোপালের ভাইয়েরও বাদ্যযন্ত্রের দোকান আছে।

পারিবারিক ব্যবসার বর্তমান অবস্থা কী—প্রশ্ন করতেই গোপালের হাসি হারিয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে গোপাল বলেন, ‘সবকিছুর দাম বাড়ে। চামড়ার দাম দিন দিন বাড়তেছে। কিন্তু আমাদের মজুরি আর বাড়ে না। আগে আমাদের বেচাকেনা ভালো ছিল। কিন্তু এখন ইলেকট্রিক যন্ত্র আসছে। লোকবাদ্যের ঐতিহ্য তো হারায় যাচ্ছে। আমরাও জীবিকা হারাচ্ছি।’

আবার তবলা মেরামতে মন দিলেন গোপাল। কিছুক্ষণ পর বললেন, এখন যেভাবে ব্যবসা চলছে, তা দিয়ে ঘরভাড়া দিয়ে কোনোরকমে পেটে-ভাতে সংসার চালাতে পারছেন। কিন্তু তাঁর অনেক দেনা আছে। দুই মেয়ের বিয়েতে প্রায় এক লাখ টাকার মতো ঋণ করেছেন তিনি। এখনো সেই ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি। ঋণ নিয়ে এখন তিনি বেকায়দায় পড়েছেন।

আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় গোপালদের তৈরি লোকবাদ্যযন্ত্র দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে
ছবি: আনিস মাহমুদ

গোপালের সঙ্গে যোগ দিলেন ছেলে রিপন দাস। তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু এগুলো কাজই শিখেছি। বাপ-দাদা সবাই এই কাজ করে আসছে। অন্য ব্যবসা কিংবা কাজ যে করব এর কোনো উপায় নেই। দিনে দিনে সংসার বড় হচ্ছে, খরচ বাড়ছে। আর এদিকে এসব যন্ত্রের চাহিদা কমছে।’

গোপাল ও তাঁর ছেলেরা বলেন, এখন মানুষ আধুনিক ইলেকট্রিক যন্ত্রের প্রতি বেশি আগ্রহী। আবার নতুন নতুন কিছু যন্ত্র বের হয়েছে, যা দিয়ে তবলা, খোল, ঢোলের আওয়াজ বাজানো যায়। এদিকে চামড়ার দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। তবলার দুটি চামড়ার দাম পড়ে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। কাঠের কাজ করে সব মিলিয়ে খরচ যায় ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা। সবকিছু শেষে ব্যবসায়ীদের হাতে খুব বেশি টাকা থাকে না।

রিপন দাস আরও বলেন, ‘চামড়ার দাম বেড়ে যাওয়ার ক্রেতারা মনে করেন আমরা মজুরি বাড়িয়েছি। কিন্তু আগে যে চামড়া ২০০ টাকায় পাওয়া যেত, সেটির দাম এখন ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। এতে তবলার দাম বেড়ে গেছে। কিন্তু ক্রেতারা দাম শুনে বিভ্রান্ত হন।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এখন নতুন ঢাকের দাম ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। তবলা বিক্রি হয় সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা। খোলের দাম সাড়ে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকার মধ্যে। ঢাক তৈরি করা হয় আম কাঠ এবং চামড়া দিয়ে। তবলা তৈরি হয় নিম কাঠ অথবা স্টিলের অবকাঠামো দিয়ে। গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ীই এসব বাদ্যযন্ত্র বানিয়ে দেওয়া হয়।

গোপাল দাস বলেন, ‘লোকবাদ্য যেমন শ্রুতিমধুর, ইলেকট্রনিক যন্ত্র তেমন নয়। তবে তরুণ প্রজন্মের কাছে লোকবাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার দিন দিন কমছে। আদি ঐতিহ্য হিসেবে লোকবাদ্যগুলো টিকিয়ে রাখা প্রয়োজন। আগে ঘরে ঘরে গান শেখানোর জন্য শিক্ষক রাখা হতো। এখন সেটিও আর দেখা যায় না। এ জন্য আমাদের এসব বাদ্যযন্ত্রের চাহিদাও কমেছে।’

তবে এরপরও টিকে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে চান গোপাল দাস। কষ্ট করে হলেও বাপ-দাদার এ পেশা ছাড়বেন না বলে জানান তিনি।