সেন্ট মার্টিনে যাত্রায় সঙ্গী যখন গাঙচিল

টেকনাফ থেকে পর্যটকবাহী জাহাজ ছুটছে সেন্ট মার্টিনের দিকে। সঙ্গী হয়ে পিছু নেয় অসংখ্য গাঙচিলছবি: প্রথম আলো

টেকনাফ থেকে ৩৪ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরে ৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রবাল সমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্ট মার্টিন। যেতে হয় টেকনাফ কিংবা কক্সবাজার শহর থেকে জাহাজ, নৌযান স্পিডবোট ও কাঠের ট্রলারে।

গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৯টার পর টেকনাফ স্থলবন্দরের উত্তর পাশে দমদমিয়া জেটিঘাট দিয়ে কয়েক হাজার পর্যটক নিয়ে সেন্ট মার্টিনের দিকে রওনা দেয় ৯টি জাহাজ ও ৩০টির বেশি স্পিডবোট ও ট্রলার। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ১৮ কিলোমিটারের নাফ নদী ও ১৬ কিলোমিটারের বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে নৌযানগুলো পৌঁছে যায় সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। দীর্ঘ এই পথটুকু জাহাজের পেছনে পেছনে ছুটে পর্যটকদের বিনোদন সঙ্গী হয় সাদা গাঙচিল।

জাহাজ থেকে গাঙচিলকে লক্ষ্য করে চিপস, বিস্কুট কিংবা পাউরুটি নিক্ষেপ করা নিষেধ। তারপরও পর্যটকেরা কাজটি করে চলেন। নইলে গাঙচিলকে হাতের কাছে পাওয়া যায় না। মুঠোফোনে তোলা হয় না ছবি, কিংবা ধারণ করা যায় না ভিডিওচিত্র।

টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন যাত্রাপথে গাঙচিলের এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। পাখিগুলো দল বেঁধে পিছু নেয় জাহাজের। জাহাজ যত দ্রুতগতিতে ছুটে, গাঙচিলের দলও তত দ্রুতগতিতে এগিয়ে যায়। জাহাজের রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে নারী, পুরুষ, শিশু, কিশোর—সবাই গাঙচিলকে কিছুক্ষণের জন্য আপন করে নিচ্ছিলেন। জাহাজের পেছনে ছুটছে ছুটছে ক্লান্ত হলে কিছুক্ষণের জন্য গাঙচিল নাফ নদী কিংবা সাগরের পানিতে গা ভাসায়। পরক্ষণে আবার ছুটছে জাহাজের পেছনে পেছনে।

নাফ নদীর পূর্ব দিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য ও মংডু জেলা শহর। পশ্চিম পাশে টেকনাফ শহর ও সবুজ প্যারাবন। সকালে প্যারাবনের পাশ ঘেঁষে নীলজলের ওপর দিয়ে জাহাজের সঙ্গে ছুটে চলা গাঙচিলগুলোর হাঁকডাক নজর কাড়ে পর্যটকের। সব শ্রেণি-পেশার মানুষ জাহাজ থেকে হাত বাড়িয়ে গাঙচিলের সান্নিধ্য উপভোগ করেন। জাহাজ থেকে পর্যটকেরা চিপস, বিস্কুট ছুড়ে মারলে দল বেঁধে গাঙচিল হাতের কাছে এসে উড়তে থাকে। এভাবে সাবরাং, নয়াপাড়া, জালিয়াপাড়া, শাহপরীর দ্বীপ অতিক্রম করে দুপুর নাগাদ জাহাজ চলে আসে বঙ্গোপসাগরে। উত্তাল বঙ্গোপসাগরেও পর্যটকের সঙ্গী হয় শত শত গাঙচিল।

আটলান্টিক জাহাজের ব্যবস্থাপক আজিজুর রহমান বলেন, ২০০৪ সাল থেকে তিনি জাহাজ নিয়ে টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনে পর্যটক পারাপার করছেন। সব সময় তিনি জাহাজের সঙ্গে গাঙচিলের ছুটে চলার দৃশ্য দেখে আসছেন। গাঙচিলের এমন দৃশ্য দেখে মুগ্ধ পর্যটকেরা। ভালোবেসে তাঁরা গাঙচিলকে খেতে দেন চিপস, বিস্কুটসহ নানা খাবার।

ঢাকার উত্তরার ব্যবসায়ী আলমগীর কুমকুম স্ত্রী, বোন ও দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে সেন্ট মার্টিন ভ্রমণে যাচ্ছেন। এক মেয়ে ও এক বোন গাঙচিলের দৌড়ঝাঁপের ভিডিওচিত্র ধারণ করছেন। আলমগীর বলেন, এমন দৃশ্য দেশের অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া কঠিন। গাঙচিলগুলো দেখতে দারুণ। জাহাজে চড়ে আড়াই ঘণ্টার যে ক্লান্তি, তা নিমিষে দূর করে দেয় গাঙচিলগুলো।

চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের গৃহবধূ সাবেকুন্নাহার টেকনাফ থেকেই গাঙচিল নিয়ে ব্যস্ত। জাহাজটি নাফ নদী অতিক্রম করে বঙ্গোপসাগরে পৌঁছায় যখন, তখনো তিনি গাঙচিল নিয়ে ব্যস্ত। জানতে চাইলে সাবেকুন্নাহর বলেন, ‘এমন আনন্দ আর পাওয়া যাবে না। গাঙচিলগুলোর জন্য মায়া জমে গেল।’ গাঙচিল লক্ষ্য করে তিনি ছুড়ে মারেন একটি পাউরুটি। কয়েকটি গাঙচিল ছোঁ মেরে ঠোঁট দিয়ে পাউরুটি ভাগাভাগি করে নিল। একটু পর চিপসের টুকরো ছুড়ে মারলে তা খেতেও দৌড়ঝাঁপ শুরু করে গাঙচিলগুলো।

জাহাজের কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বেলা তিনটার দিকে সেন্ট মার্টিন থেকে টেকনাফের উদ্দেশে ফেরার সময়ও গাঙচিল সঙ্গী হয় পর্যটকদের। বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে জাহাজ যখন বিকেল পাঁচটার দিকে নাফ নদীতে প্রবেশ করে, তখন পশ্চিম আকাশে লাল আভা ছড়িয়ে সূর্য অস্তে চলে। তখনো গাঙচিলের ভালোবাসা সতেজ থাকে। সূর্যাস্তের পর যখন অন্ধকার নেমে আসে, তখন গাঙচিলগুলো যেন কোথায় হারিয়ে যায়।

কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদ সভাপতি দীপক শর্মা বলেন, প্যারাবনের আশপাশে, নাফ নদী ও সমুদ্র উপকূলে গাঙচিলের বসবাস। কয়েক বছর আগেও নাফ নদী, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, শাহপরীরদ্বীপ, টেকনাফ, কক্সবাজার, মহেশখালী, কুতুবদিয়া সমুদ্র উপকূলে হাজার হাজার গাঙচিলের দেখা মিলত। এখন বহু জায়গায় গাঙচিল হারিয়ে গেছে, সম্ভবত খাদ্যের অভাবে। সবচেয়ে বেশি গাঙচিল দেখা যায় টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন এলাকায়। বিশেষ করে পর্যটকবাহী  জাহাজগুলোর আশপাশে গাঙচিলগুলো বিচরণ করে খাদ্যের আশায়। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, গাঙচিলকে জাহাজে থেকে খেতে দিতে নেই। তাতে পাখির মৃত্যুর পাশাপাশি নদীর পরিবেশ নষ্ট হয়, ধ্বংসের শঙ্কা থাকে জীববৈচিত্র্যের।