ফেসবুকে প্রকৌশলীর ঘুষ নেওয়ার ভিডিও: ‘ওমনে টাকা ধইরে বসে থাকা যাবে না, যে কেউ রুমে ঢুকতে পারে’

উপসহকারী প্রকৌশলী কাঞ্চন কুমার পালিত (বামে) তাঁর পকেটে টাকাগুলো রেখে দিচ্ছেনছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদের দুই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি এ–সংক্রান্ত একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বিষয়টি নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। তবে ভিডিওটি আট মাস আগের দাবি করে অভিযুক্ত এক প্রকৌশলী জানান, ওই অর্থ ঘুষের নয়।

অভিযুক্ত দুজন হলেন জেলা পরিষদের উপসহকারী প্রকৌশলী কাঞ্চন কুমার পালিত ও সহকারী প্রকৌশলী রিয়াদুল কুদ্দুস। তবে রিয়াদুল কুদ্দুস কয়েক মাস আগে নারায়ণগঞ্জ থেকে অন্য জায়গায় বদলি হয়েছেন।

প্রায় পাঁচ মিনিটের ওই ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, জেলা পরিষদ কার্যালয়ে সহকারী প্রকৌশলী রিয়াদুল কুদ্দুসের কক্ষে গিয়ে সোফায় বসেন জহির নামের এক ঠিকাদার। জহির তাঁদের উদ্দেশ করে বলেন, ‘এখানে মানুষজন নেই, তাড়াতাড়ি বলে ফেলি, আমাদের সঙ্গে লজ্জাশরমের কিছু নাই। সবকিছু কিন্তু ক্লিয়ার হয়ে গেছে।’

কিছুক্ষণ পর জহির যোগ করেন, ‘আপনারা পেরেশান হয়েন না, আপনাদের সব কথা আমি শুনব। আপনি যেটা বলবেন, সেটা আমি শুনব। একের (এক লাখ) ভেতরে আমার ওইটা শেষ করে দেওয়া যায় কি না?’ জবাবে প্রকৌশলী রিয়াদুল কুদ্দুস বলেন, ‘পেমেন্টটা?’ এ সময় উপসহকারী প্রকৌশলী কাঞ্চন কুমার পালিত আপত্তি জানালে জহির আবার বলেন, ‘আপনারা বেজার হয়েন না, আমি আপনাদেরকে পুরো দেড়ই দেব।’ এর উত্তরে কাঞ্চন কুমার পালিত বলেন, ‘আপনি দেড়ই দেবেন, তারপর আমরা দেখব।’ এবার জহির রাজি বলে জানান। তখন উপসহকারী প্রকৌশলী কাঞ্চন কুমার পালিত জহিরকে উদ্দেশ বলেন, ‘আমরা রিস্ক নিয়ে কাজটা করে দিয়েছি।’

কথোপকথনের একপর্যায়ে ঘুষের টাকার পরিমাণ নিয়ে ওই দুই প্রকৌশলীর সঙ্গে দর-কষাকষি করেন জহির। এর মধ্যে সেখানে বসেই এক হাজার টাকার একটি বান্ডিল বের করেন জহির। জহিরকে ইশারায় বান্ডিলটি দেখিয়ে সহকারী প্রকৌশলী রিয়াদুল কুদ্দুস বলেন, ‘এই! ওমনে (টাকা) ধইরে নিয়ে বসে থাকা যাবে না; যে কেউ রুমে ঢুকতে পারে।’ এ কথা শুনে তখনই এই বান্ডিল নিজের কাছে চেয়ে নেন উপসহকারী প্রকৌশলী কাঞ্চন কুমার পালিত।

কথোপকথনের একপর্যায়ে ঘুষের টাকার পরিমাণ নিয়ে ওই দুই প্রকৌশলীর সঙ্গে দর-কষাকষি করেন জহির। এর মধ্যে সেখানে বসেই এক হাজার টাকার একটি বান্ডিল বের করেন জহির। জহিরকে ইশারায় বান্ডিলটি দেখিয়ে সহকারী প্রকৌশলী রিয়াদুল কুদ্দুস বলেন, ‘এই! ওমনে (টাকা) ধইরে নিয়ে বসে থাকা যাবে না; যে কেউ রুমে ঢুকতে পারে।’ এ কথা শুনে তখনই এই বান্ডিল নিজের কাছে চেয়ে নেন উপসহকারী প্রকৌশলী কাঞ্চন কুমার পালিত। জহির ওই বান্ডিল এগিয়ে দিলে আরও টাকার আবদার করেন কাঞ্চন কুমার। পরে রিয়াদুল কুদ্দুস তাঁর সহকর্মীকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আগে ওইটা (টাকা) ঢুকান; পরেরটা পরে।’ এবার কাঞ্চন কুমার তাঁর ডান পকেটে টাকাগুলো রেখে দেন।

পরে আরও কিছু টাকা বের করে গুনতে থাকেন জহির। তাড়াতাড়ি টাকাগুলো হাতে দেওয়ার জন্য বলতে থাকেন ওই প্রকৌশলীরা। জহির এই অর্থকে ২৫ হাজার টাকা দাবি করে আবারও কাঞ্চনের হাতে তুলে দেন। তখন প্রথমে ১০ এবং পরে সেটি কমিয়ে আরও ৫ হাজার টাকা দাবি করেন ওই প্রকৌশলীরা। জহির এই অর্থ দিতে রাজি না হলে রিয়াদুল কুদ্দুস জহিরকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘তাহলে তো মুশকিল!’

একটি প্রকল্পের কাজে যে টাকাটা আমরা খরচ করেছিলাম, সেই টাকা দেওয়ার বিষয়টি গোপনে ভিডিও করে আমাদের ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করে আসছিল জহির। এটা কোনো ঘুষের টাকা নয়, আর ভিডিওটি ১০ মাস আগের।
অভিযুক্ত উপসহকারী প্রকৌশলী কাঞ্চন কুমার পালিত

এগুলো ঘুষের টাকা নয় বলে দাবি করেছেন অভিযুক্ত উপসহকারী প্রকৌশলী কাঞ্চন কুমার পালিত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্ষায় ভবনের তিন তলায় ছাদের পানি পড়ার কারণে জরুরি ভিত্তিতে ১০ মাস আগে সাড়ে তিন লাখ টাকায় কাজটি করা হয়। জহিরকে চেয়ারম্যান স্যার কাজটা দিয়েছিলেন। অর্ধেক কাজ করেছিল জহির, বাকি অর্ধেক কাজ আমরা মালামাল কিনে সম্পন্ন করি। ওর (জহির) নামে আমরা টাকা তুলে কাজটি করেছিলাম।’

কাঞ্চন কুমার পালিত আরও দাবি করেন, ‘যে টাকাটা আমরা খরচ করেছিলাম, সেই টাকা দেওয়ার বিষয়টি গোপনে ভিডিও করে আমাদের ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করে আসছিল জহির। এটা কোনো ঘুষের টাকা নয়, আর ভিডিওটি ১০ মাস আগের।’

অভিযুক্ত সহকারী প্রকৌশলী রিয়াদুল কুদ্দুস বদলি হয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। এই ঘুষের টাকার সঙ্গে জেলা পরিষদের অন্য কর্মকর্তারা জড়িত থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান চন্দন শীল

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জহির নামের ওই ব্যক্তি পেশায় একজন ঠিকাদার। তিনি জেলা পরিষদে বেশ কিছু ঠিকাদারি কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি চন্দন শীলের সঙ্গে জহিরের বেশ সখ্য আছে বলে অভিযোগ করেন অনেকেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান চন্দন শীল প্রথম আলোকে বলেন, জহির তাঁর সঙ্গে আগে থাকলেও টাউট–বাটপারির কারণে তাঁকে বের করে দেওয়া হয়েছে। ওই দুই প্রকৌশলীর ঘুষ গ্রহণের বিষয়ে চন্দন শীল বলেন, অভিযুক্ত সহকারী প্রকৌশলী রিয়াদুল কুদ্দুস বদলি হয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। এই ঘুষের টাকার সঙ্গে জেলা পরিষদের অন্য কর্মকর্তারা জড়িত থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।