গজারিয়ায় পুলিশের ওপর ‘ডাকাত দলের’ হামলার ঘটনায় মামলা, পরিস্থিতি থমথমে

হামলার পর থেকে এলাকার পরিস্থিতি থমথমে। গ্রামের রাস্তাঘাট ও দোকানপাট মানুষশূন্য। মঙ্গলবার দুপুরে গজারিয়ার গুয়াগাছিয়া ইউনিয়নের জামালপুর গ্রামেছবি: প্রথম আলো

মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা নদীতে গুয়াগাছিয়া ইউনিয়নের জামালপুরে পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যদের ওপর ডাকাত দলের সদস্যদের গুলি ও ককটেল হামলার ঘটনায় মামলা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ২০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরও ২৫ থেকে ৩০ জনকে আসামি করে গজারিয়া থানায় মামলাটি করা হয়েছে।

মামলার বিষয়টি মঙ্গলবার রাত আটটার দিকে প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন গজারিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ার আলম আজাদ। তিনি বলেন, গজারিয়া থানার উপপরিদর্শক আজহারুল ইসলাম খান বাদী হয়ে মামলাটি করেছেন। মামলায় নৌ ডাকাত পিয়াসকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। মামলায় ২০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া অজ্ঞাত হিসেবে আরও ২৫ থেকে ৩০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

ঘটনার পর গতকাল গজারিয়ার গুয়াগাছিয়া, চাঁদপুরের বেলতলী ও মতলবের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়েছেন যৌথ বাহিনীর সদস্যরা। এসব অভিযানে কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করতে পারেননি তাঁরা।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত সোমবার বিকেল সোয়া পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা পৌনে ছয়টা পর্যন্ত গুয়াগাছিয়া ইউনিয়নের জামালপুর অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প-সংলগ্ন মেঘনা নদীতে পুলিশ ও ডাকাত দলের সদস্যদের মধ্যে শতাধিক গুলি ছোড়ার ঘটনা ঘটে। এর পর থেকে জামালপুর ও শিমুলিয়া এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এলাকার অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ। রাস্তাঘাটে মানুষের যাতায়াত নেই। গ্রামের বাসিন্দারা যাঁর যাঁর ঘরে অবস্থান করছেন।

স্থানীয় উজ্জ্বল দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্রামের লোকজনের মধ্যে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা ভয়ে ঘরে অবস্থান করছি। (মঙ্গলবার) সকাল থেকে পুলিশ ক্যাম্পেও পুলিশকে সতর্ক অবস্থানে দেখেছি। পুলিশের ওপর গুলিবর্ষণকারীরা অনেক দুর্ধর্ষ। তারা এখনো কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। যেকোনো সময় আবার হামলার ঘটনা ঘটতে পারে।’

ওসি আনোয়ার আলম আজাদ জানান, থানা–পুলিশ, নৌ পুলিশ, কোস্টগার্ড এবং র‍্যাব-১১–এর সদস্যদের নিয়ে মঙ্গলবার দিনভর যৌথভাবে গুয়াগাছিয়া, চাঁদপুরের মতলব, বেলতলী এলাকাসহ মেঘনা নদীর সম্ভাব্য সব স্থানে অভিযান চালানো হয়েছে। ডাকাত বাহিনীর সদস্যরা বিচ্ছিন্ন হয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন। তাঁদের গ্রেপ্তার করতে পুলিশ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘গ্রামের মানুষ এত দিন ভয়ে মুখ খোলার সাহস পায়নি। তারা আমাদের কাছে আসতে শুরু করেছে। ডাকাত দলের কাউকে এবার ছাড় দেওয়া হবে না।’

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে গুয়াগাছিয়া ইউনিয়নের মেঘনা ও শাখা নদীতে অবৈধ বালুমহাল পরিচালনা, নৌযানে চাঁদাবাজি করে আসছে নয়ন, পিয়াস, রিপন ও লালু বাহিনীর সদস্যরা। গত এক বছরে নদীতে কয়েক দফা গোলাগুলিতে খুন হন অন্য ডাকাত পক্ষের সরদার বাবলা। এক মাস আগে বালু উত্তোলনে বাধা দিতে গিয়ে গুলিতে নিহত হন আবদুল মান্নান ও হৃদয় আহমেদ নামের আরও দুজন। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গত শুক্রবার জামালপুর গ্রামে একটি অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প চালু করা হয়। ক্যাম্প চালু হওয়ার পর এলাকাবাসী মিষ্টি বিতরণ করেন। অপর দিকে পুলিশ ক্যাম্প সরিয়ে নিতে শনিবার মানববন্ধন করেন ডাকাত পক্ষের লোকজন।

সোমবারের ঘটনা নিয়ে পুলিশ সূত্রে জানা যায়, এদিন বিকেল পাঁচটার পরপর পাঁচ-ছয়টি দ্রুতগতির ইঞ্জিনচালিত ট্রলার নিয়ে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প-সংলগ্ন মেঘনা নদীতে মহড়া শুরু করেন নৌ ডাকাত নয়ন, পিয়াস, রিপন ও আক্তার পক্ষের ৩০ থেকে ৪০ জন। এ সময় ক্যাম্পের পুলিশ সদস্যরা ডাকাত দলের উপস্থিতি টের পেয়ে নদীতে অভিযানে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। পুলিশের প্রস্তুতির বিষয়টি আন্দাজ করতে পেরে ডাকাত দলের সদস্যরা চাঁদপুরের বেলতলীর দিকে চলে যান।

একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, পুলিশের ধাওয়ার কিছুক্ষণ পর সোয়া পাঁচটার দিকে মাথায় হেলমেট, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরে আগ্নেয়াস্ত্র, ছুরি, ককটেল নিয়ে ক্যাম্পের দিকে ছুটে আসেন ডাকাত দলের সদস্যরা। তাঁরা ক্যাম্প ও টহলে থাকা পুলিশকে লক্ষ্য করে একের পর এক ককটেল ও গুলি ছুড়তে থাকেন। আত্মরক্ষায় পুলিশ সদস্যরাও পাল্টা গুলি চালান। এ সময় ডাকাতদের পক্ষ থেকে প্রায় ১০০ ও পুলিশের পক্ষ থেকে ২০টির মতো গুলি ছোড়া হয়। আধা ঘণ্টার বেশি সময় ধরে উভয় পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি চলে। একপর্যায়ে পুলিশের প্রতিরোধের মুখে পৌনে ছয়টার দিকে ট্রলার নিয়ে মতলবের দিকে চলে যায় হামলাকারীরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, নয়ন, পিয়াস, রিপন ও লালু বাহিনীর ভয়ে এলাকার মানুষ মুখ খোলার সাহস পান না। কেউ কথা বললে হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়। তাঁদের ভয়ে ইউনিয়নের শতাধিক পরিবার গ্রামছাড়া হয়েছে। পুলিশের ক্যাম্প চালু হওয়ার পর গ্রাম ছেড়ে পালানো মানুষ গ্রামে ফিরতে শুরু করেন। পুলিশের তৎপরতায় ডাকাত দলও তাদের কার্যক্রম চালাতে বাধার মুখে পড়ে। এ জন্য ডাকাতেরা ভয়ভীতি দেখিয়ে কিংবা হামলা করে এখান থেকে পুলিশ ক্যাম্প সরাতে চাচ্ছে।

মুন্সিগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফিরোজ কবির প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা পুলিশের ওপর হামলার চেষ্টা করেছে, তাঁদের আটকের চেষ্টা চলছে। হামলার ঘটনায় অস্ত্র ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে মামলা প্রক্রিয়াধীন। কোনো ডাকাত-সন্ত্রাসীকে পুলিশ ভয় পায় না। গুয়াগাছিয়ার সব ডাকাত-সন্ত্রাসীকে নির্মূল করা হবে। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের ভয়ের কিছুই নেই। পুলিশ তাঁদের সঙ্গে আছে।