পায়ে লিখে জিপিএ–৫ পেয়েছে দুই হাতবিহীন রফিকুল

পা দিয়ে লিখে জিপিএ ৫ পেয়েছে দুই হাতবিহীন রফিকুল ইসলাম ওরফে রাব্বি। আজ দুপুরে সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী ইউনিয়নের পূর্ব হাসনাবাদ গ্রামেপ্রথম আলো

পায়ে লিখে এবার এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিদ্যুৎস্পৃষ্টে দুই হাত হারানো রফিকুল ইসলাম ওরফে রাব্বি। আজ রোববার বেলা ১১টার দিকে তার এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলে পরিবারে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়।

রফিকুল ইসলাম রাব্বি ভাটিয়ারী ইউনিয়নের পূর্ব হাসনাবাদ গ্রামের দিনমজুর বজলুর রহমানের ছেলে। তিন ভাইবোনের মধ্যে সে সবার বড়। রাব্বি উপজেলার ভাটিয়ারী হাজী টিএসি উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। তার একমাত্র বোন রোকাইয়া আক্তারও এবার একই বিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। সাত বছর আগে এক দুর্ঘটনায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে রাব্বিকে দুটি হাত হারাতে হয়। এর পর থেকে তার সংগ্রাম শুরু।

তার ফলাফল জানতে আজ বেলা দুইটার দিকে রাব্বির বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের বাইরে চেয়ারে বসে পা দিয়ে মুঠোফোনে ফলাফলের স্ক্রিনশট নিচ্ছিল রাব্বি। এ সময় তার বাবা বজলুর রহমান বাড়িতে কাজ করছিলেন।

রাব্বি প্রথম আলোকে বলে, তার একটি বিষয়ে শুধু ‘এ’ গ্রেড এসেছে। বাকি সব বিষয়ে এ-প্লাস ফলাফল করেছে সে। এক বিষয়ে একটু কম নম্বরের জন্য তার কোনো আফসোস নেই। সে এগিয়ে যেতে চায়।

রাব্বি জানায়, রেজাল্ট প্রকাশের ২০ মিনিট পর থেকে বন্ধু, আত্মীয়স্বজন ফোন করে তার ফলাফলের খবর জানতে চেয়েছে। রেজাল্ট শুনে সবাই খুশি হয়ে তাকে দোয়া করেছেন। সে একটি সরকারি কলেজে ভর্তি হতে চায়। সেখান থেকে ভালো ফলাফল করে একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে, এমন স্বপ্ন দেখে।

তার বাবা বজলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ছেলে ঠিকমতোই এগোচ্ছে। তাঁরা আশানুরূপ ফলাফল পেয়েছেন। সে যে পর্যন্ত পড়তে চায়, যে করেই হোক, তাকে পড়াবেন।

রাব্বি পরিবারের সঙ্গে ১২ বছর ধরে নানাদের দেওয়া একটি ছোট্ট টিনের ঘরে থাকে। তাদের পরিবারের সদস্য পাঁচজন। ছোট ঘরে ঠাসাঠাসি করে থাকতে হয়।

কীভাবে সংসার চলে জানতে চাইলে রাব্বির বাবা বজলুর রহমান বলেন, একসময় তিনি জাহাজভাঙা কারখানার শ্রমিক ছিলেন। ছেলের দুর্ঘটনার পর তাঁর সংসার এলোমেলো হয়ে যায়। প্রায় ১৪ লাখ টাকা ঋণের মধ্যে পড়েন। ফলে তিনি ও তাঁর স্ত্রী দুজনেই শ্রমিকের কাজ করে ঋণশোধের পাশাপাশি সংসার চালান। পাশাপাশি তিন ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ দেন। সম্প্রতি তিনিও অসুস্থ হয়েছেন। এখন রাব্বির মায়ের আয়ে তাঁদের সংসার চলে।

এর আগে যখন এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়, তখন তার জন্য কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ সমান উচ্চতার দুটি বেঞ্চ পাশাপাশি দিয়ে তাকে লিখতে দেয়। দুটি বেঞ্চের ওপর বসে পা দিয়ে লিখে রাব্বি পরীক্ষা দেয়।

এর আগে ২০১৮ সালে মুখে কলম ধরে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা দিয়েছিল রাব্বি। ওই বছরের ১৯ নভেম্বর রাব্বিকে নিয়ে ‘সকল বাধা তুচ্ছ করে’ শিরোনামে প্রথম আলোতে সচিত্র সংবাদ ছাপা হয়। পাশাপাশি ‘কলম কামড়ে লিখে যাচ্ছে ছেলেটি’ শিরোনামে প্রথম আলো অনলাইনেও প্রকাশিত হয় সংবাদটি। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় মুখ দিয়ে লিখে ৪ দশমিক ৮৩ পয়েন্ট পেয়েছিল সে।

চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি ‘এবার পায়ে লিখে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে সেই রফিকুল’ শিরোনামে প্রথম আলোতে আরেকটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

রফিকুল জানায়, ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে সে ধীরে ধীরে পায়ে লেখার অভ্যাস শুরু করে। আর এভাবে সব শ্রেণিতে পায়ে লিখে পরীক্ষা দিয়ে সে উত্তীর্ণ হয়েছে।

২০১৬ সালের ৫ অক্টোবর ভাটিয়ারী হাজী টিএসি উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে পদচারী-সেতুর নির্মাণকাজ চলছিল। শ্রমিকেরা পুরো কাজ শেষ না করে সেতুটি খোলা রাখেন। ওই দিন দুপুরে টিফিন পিরিয়ডে কিছু শিক্ষার্থী স্কুল থেকে বের হয়ে বাজারে যায়। রফিকুল পদচারী-সেতু খোলা পেয়ে সেটি দিয়ে পারাপারের চেষ্টা করছিল। এ সময় পাশে থাকা বিদ্যুতের লাইনে সে দগ্ধ ও আহত হয়। পরে বিজয় সরণি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের এক ছাত্র রফিকুলকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করেন।

রফিকুলের বাবা বজলুর রহমান বলেন, রফিকুলকে নিয়ে প্রথমবার প্রথম আলোতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর তার পড়াশোনার দায়িত্ব নেন গবেষক ড. ফেরদৌসী কাদরী। পাশাপাশি প্যাসিফিক জিনসও সহযোগিতা করেছে।