দুই পরিবারের সব স্বপ্নই শেষ

চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত আব্দুল মোতালেবের দুই মেয়ে সেলিনা আকতার ও উম্মে আয়মনের আহাজারী থামছেই না। গতকাল বিকেল তিনটায় ধলই ইউনিয়নের উদালিয়া গ্রামেপ্রথম আলো

মাত্র ২০ বছর বয়সে আয়ের আশায় কাতারে গিয়েছিলেন মোহাম্মদ আবসার (৫৫)। দীর্ঘ ৩৫ বছরের প্রবাসজীবনে মাঝেমধ্যে দেশে আসতেন তিনি। কিন্তু জীবিকার তাগিদে ছুটতে হতো আবার। পরিবার-পরিজন থেকে দূরে থাকার কারণে ছিল আক্ষেপ। তাই এমন ব্যস্ততার জীবন ছেড়ে দেশে থিতু হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

স্বপ্ন দেখছিলেন মা, স্ত্রী-কন্যাদের নিয়ে দেশেই সুন্দর সময় কাটানোর। কিন্তু তাঁর এই স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দিয়েছে ঘাতক বাস। গাড়িচাপায় প্রাণ গেছে এই প্রবাসীর। এখন পরিবারে চলছে শোকের মাতম। পরিবারের একমাত্র অবলম্বন বটবৃক্ষ হারিয়ে অন্ধকার নেমেছে স্বজনদের মধ্যে।

গত শনিবার বেলা দেড়টায় উল্টো পথে আসা একটি বাসের ধাক্কায় দুমড়েমুচড়ে যায় মোহাম্মদ আবসারদের বহনকারী সিএনজিচালিত অটোরিকশা। ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। মারা যান তাঁর সঙ্গে থাকা স্বজন আবদুল মোতালেবও (৫৮)। চট্টগ্রামের হাটহাজারীর খাগড়াছড়ি আঞ্চলিক মহাসড়কের মির্জাপুর ইউনিয়নের মইগ্যের হাট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত অবস্থায় আরও দুজন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বাসচালককে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি বাসটি জব্দ করেছে হাইওয়ে পুলিশ।

নিহত আবসার ও মোতালেব দুজন মামাতো ফুফাতো ভাই। আবসারের বাড়ি হাটহাজারী উপজেলার ধলই ইউনিয়নের এনায়াতপুর গ্রামে। সম্প্রতি কেনা ৪০ শতক জমির নিবন্ধন নিয়ে জায়গার মালিকের সঙ্গে আলাপ করতে চট্টগ্রাম শহরে গিয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকে ফেরার পথে বাসাচাপায় মারা যান তিনি। তাঁর সংসারে রয়েছেন মা, স্ত্রী ও পাঁচ মেয়ে।

যে সময়ে দুর্ঘটনা ঘটে, তখন ঘরে স্বামীর অপেক্ষায় ছিলেন স্ত্রী রোশনারা বেগম। কথা ছিল কাজ শেষ করে ঘরে ফিরবেন। দুপুরের খাওয়া একসঙ্গে সারবেন। এর মধ্যে খাবারের সব আয়োজন সম্পন্ন করেন। রান্না করেন স্বামীর পছন্দের মাছ-মাংস ও সবজি।

স্বামীর আসতে দেরি হচ্ছে দেখে মুঠোফোনে ফোন করেন। অপর প্রান্ত থেকে যে সংবাদ পান তার জন্য প্রস্তুত ছিল না রোশনারা। যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। সকালে এক সঙ্গে নাশতা করার পর স্বামীকে বিদায় দেন। এভাবে স্বামীকে হারিয়ে ফেলবেন, তা ছিল কল্পনারও অতীত। দুর্ঘটনার এক দিন পরও করুণ বাস্তবতা মেনে নিতে পারছিলেন না রোশনারা ও তাঁর স্বজনেরা।

গতকাল রোববার বেলা আড়াইটার দিকে নিহত মোহাম্মদ আবসারের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পাকা দালানের বাড়িতে একের পর এক আসছেন স্বজনেরা। নির্বাক চাপা কষ্টে আহাজারি করছিলেন আবসারের স্ত্রী ও তিন মেয়ে।

আগের দিন শনিবার রাতে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। মোহাম্মদ আবসারের স্বজনেরা জানান, প্রায় ৩৫ বছর আগে কাতারের দোহায় যান আবসার। এর পাঁচ বছর পর এসে বিয়ে করেন রোশনারা বেগমকে। এরপর ঘর আলোকিত করে আসে একে একে পাঁচ মেয়ে। চতুর্থ কন্যা নিলুফার ইয়াসমিনকে বিয়ে দিতে গত ১৫ জানুয়ারি দেশে এসেছিলেন তিনি। ইতিমধ্যে মেয়ের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। ছোট মেয়ে ফারজানা ইয়াসমিন এইচএসসি প্রথম বর্ষে পড়ছে। কাতারে ঠিকাদারি ও গাড়ির ব্যবসা ছিল আবসারের।

বিলাপ করতে করতে আবসারের স্ত্রী রোশনারা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশে আর থাকতে চাইছিলেন না। দেশে স্থায়ী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ১০ জুলাই কাতারে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। পরিকল্পনা ছিল আগামী বছরেই একেবারে দেশে ফিরে আসবেন। কিন্তু ঘাতক বাস তাঁদের সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়ে গেল।

শোকের আহাজারি চলছিল বাসচাপায় নিহত আবদুল মোতালেবের গ্রামের বাড়িতেও। তিনি জায়গাজমি বিক্রিতে মধ্যস্থতা করতেন। তাঁর সংসারে রয়েছে স্ত্রী ও তিন মেয়ে। হাটহাজারীর ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের উদালিয়া গ্রামের বাসিন্দা আবদুল মোতালেবের বাড়িতে গতকাল বিকেলে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর দুই মেয়ে বাড়ির উঠানে বিলাপ করছেন। মোতালেবের স্ত্রী আগে থেকে অসুস্থ। এ খবর পেয়ে শয্যাশায়ী হয়েছেন তিনি।

দুই বোন সেলিনা আকতার ও উম্মে আয়মন বলেন, গত দুই মাস আগে বাবা ওমরাহ হজ করে দেশে আসেন। এর মধ্যে যে বাবা চিরতরে চলে যাবেন, তা কল্পনাও করেননি।
হাইওয়ে পুলিশ সূত্র জানায়, এই সড়কে গত এক বছরে শতাধিক দুর্ঘটনায় অন্তত ৫০ জন নিহত এবং কয়েক শ মানুষ আহত হয়েছেন।