চারটি আসনে বিএনপিতে অসন্তোষ, আগেভাগেই প্রচারে জামায়াত

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছয়টি সংসদীয় আসনের মধ্যে একটি ছাড়া প্রতিটিতেই বিএনপির প্রার্থী নিয়ে একাংশের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। ঘোষিত চারটি আসনের মধ্যে তিনটিতেই প্রার্থী পুনর্বিবেচনার দাবি উঠেছে। দুটি আসন যুগপৎ আন্দোলনের দুই শরিক দলকে ছেড়ে দেওয়ার আলোচনা রয়েছে রাজনীতির মাঠে। অন্যদিকে আগেভাগে প্রার্থী ঘোষণা করে প্রচারে আছে জামায়াতে ইসলামী।

জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী ঘোষণা না করলেও সদরসহ কয়েকটি আসনে দলটির নেতারা তৎপর আছেন। এককভাবে প্রতিটি আসনে প্রচারণা চালাচ্ছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। এছাড়া বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) তিনটিতে এবং গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকিসহ দুজন দুটি আসনে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রাজনীতিতে একসময় আওয়ামী লীগের আধিপত্য ছিল। ৫ আগস্টের পর দলটির নেতা-কর্মীদের অধিকাংশই আত্মগোপনে। একইভাবে জাতীয় পার্টির (জাপা) সাংগঠনিক কার্যক্রম নেই বললেই চলে। জেলা জাপার সাধারণ সম্পাদক নাসির আহমেদ খান বলেন, নির্বাচন নিয়ে সংশয় আছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস পেলে প্রতিটি আসনে প্রার্থী দেওয়া হবে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ (নাসিরনগর)

এই আসনটিতে আগে জিততে পারেনি বিএনপি। ১৯৭০ সালের পর আওয়ামী লীগ আটবার, জাপা দুবার, ন্যাপ একবার ও স্বতন্ত্র প্রার্থী দুবার জয়ী হয়েছেন। এবার নাসিরনগর উপজেলা বিএনপির সভাপতি মো. আবদুল হান্নানকে মনোনয়ন দিয়েছে দল।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির প্রার্থী ঘোষণার পর দলের একাংশের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। জেলা বিএনপির সহসভাপতি ও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি কামরুজ্জামান মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন।

বিএনপির মনোনয়ন পাওয়া আবদুল হান্নান প্রথম আলোকে বলেন, মনোনয়ন না পেয়ে অনেকে অনেক কিছু বলতে পারেন। এতে কোনো প্রভাব ফেলবে না। দিন শেষে তারেক রহমানের ডাকে সবাই মূলস্রোতে ফিরে আসবেন।

বিএনপির শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মাঠে নিয়মিত সভা-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি করছেন জামায়াতের প্রার্থী এ কে এম আমিনুল ইসলাম। তিনি উপজেলা জামায়াতের আমির। ভোটের মাঠে ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছেন বলে দাবি করেছেন তিনি।

এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলনের উপজেলা সভাপতি মাওলানা হুসাইন আহমেদ আলী ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মাওলানা সাইদুল্লা বিন আনসারী মাঠে আছেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল ও আশুগঞ্জ)

এই আসনে বিএনপি ছয়বার, জাপা তিনবার ও স্বতন্ত্র প্রার্থী একবার জয়ী হয়েছেন। এখানে এখনো প্রার্থী ঘোষণা করেনি বিএনপি। আসনটি শরিকদের ছেড়ে দেওয়ার আলোচনা রয়েছে। পাশাপাশি বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যেও কোন্দল চাঙা। এখানে জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরা সদস্য ও জেলার আমির মোবারক হোসেনকে দলীয় প্রার্থী করা হয়েছে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে এখানে সক্রিয় সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহসম্পাদক রুমিন ফারহানা। এ ছাড়া জেলা বিএনপির উপদেষ্টা ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শেখ মো. শামীম, জেলা বিএনপির সদস্য আহসান উদ্দিন খান, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান কল্যাণ ফ্রন্টের মহাসচিব এস এন তরুণ দে, সরাইল উপজেলা বিএনপির সভাপতি আনিসুল ইসলাম ঠাকুর, সরাইল উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান লস্কর, আশুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি শাহজাহান সিরাজ দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী।

গত শনিবার আশুগঞ্জে শাহজাহান সিরাজকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবিতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন তাঁর সমর্থকেরা।

বিএনপির আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী আনিসুল ইসলাম ঠাকুর বলেন, ‘এই আসন বিএনপির ঘাঁটি। আমরা চাই, দল থেকে ধানের শীষ প্রতীকের কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হোক।’

এখানে জোটের প্রার্থী হিসেবে হেফাজতে ইসলামের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব জুনাইদ আল হাবিবকে মনোনয়ন দেওয়ার আলোচনা আছে।

আসনটিতে দীর্ঘদিন ধরে গণসংযোগ করছেন জামায়াত নেতা মোবারক হোসেন আকন্দ। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলনের আশুগঞ্জ উপজেলার সহসভাপতি নেছার আহমদ আন-নাছিরী, বাংলাদেশ খেলাফত মসজিসের মাওলানা মনিরুল ইসলাম খন্দকার, সিপিবির সরাইল উপজেলা সভাপতি দেবদাস সিংহ রায় ও এনপিপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক আশরাফ মাহদী প্রার্থী হতে পারেন বলে আলোচনায আছেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর ও বিজয়নগর)

১৯৯১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আসনটিতে বিএনপি জয় পেয়েছিল। এবার কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক বিষয়ক সম্পাদক ও জেলা বিএনপির সভাপতি খালেদ হোসেন মাহবুবকে (শ্যামল) মনোনয়ন দিয়েছে দল। এই আসনে বিএনপির প্রার্থী নিয়ে অসন্তোষ নেই।

খালেদ হোসেন মাহবুব বলেন, ‘সর্বত্রই এখন ভোটের আমেজ। জনগণ বিএনপিকে সমর্থন দিচ্ছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সব আসনে বিএনপি জয়ী হবে।’

জামায়াতে ইসলামী এখানে দলের জেলা শাখার সহকারী সেক্রেটারি মো. জোনায়েদ হাসানকে প্রার্থী করেছে। তিনি বলেন, ‘প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। মাঠে দৌড়ঝাঁপ করছি। এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে।’

এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলনের জেলার সাধারণ সম্পাদক মাওলানা গাজী নিয়ামুল করিম, এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কুমিল্লা বিভাগের সমন্বয়ক মো. আতাউল্লাহ এবং জেলার সমন্বয়ক আজিজুর রহমান আলোচনায় আছেন। মো. আতাউল্লাহ বলেন, জেলার প্রতিটি আসন থেকে এনসিপির চার থেকে পাঁচজন দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। দ্রুত মনোনয়ন চূড়ান্ত করে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হবে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা ও আখাউড়া)

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মুশফিকুর রহমানকে এই আসনে মনোনয়ন দেওয়ার পর দলের একাংশের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। তারা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ব্যক্তিগত সহকারী আবদুর রহমানের (সানি) বড় ভাই ও জেলা বিএনপির সদস্য কবির আহমেদকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। মুশফিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রার্থী পুনর্বিবেচনার দাবি উঠতেই পারে। তবে আমার মনে হয় না এতে কিছু হবে।’

আসনটিতে জামায়াত ঢাকা মহানগর উত্তরের প্রচার ও মিডিয়া সম্পাদক আতাউর রহমান সরকারকে প্রার্থী করেছে। আতাউর রহমান বলেন, ‘২ জুন থেকে প্রচারণা শুরু করেছি। পরিবর্তনের হাওয়া এখানে পড়েছে। জনগণ নতুন নেতৃত্ব চাচ্ছে।’

এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলনের জেলা শাখার উপদেষ্টা মুফতি জসিম উদ্দিন ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মাওলানা কাজী মইনুদ্দীন তৎপর আছেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ (নবীনগর)

নবীনগর উপজেলা বিএনপির সভাপতি মো. আবদুল মান্নানকে মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। এতে দলের একাংশের নেতা-কর্মীরা অসন্তুষ্ট। তাঁরা জেলা বিএনপির অর্থনৈতিক বিষয়ক সম্পাদক কাজী নামজুল হোসেনকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবিতে নানা কর্মসূচি করছেন। কাজী নাজমুল হোসেন বলেন, ‘দিন শেষে যত কিছুই হোক, ধানের শীষকে জয়ী করার চেষ্টা করতে হবে। দল এখানে প্রার্থী পুনর্বিবেচনা করে এমন একজনকে মনোনয়ন দেবে, যিনি আসনটি তারেক রহমানকে উপহার দিতে পারবেন।’

আবদুল মান্নান বলেন, ‘মান-অভিমান তো থাকতেই পারে। মনোনয়ন পাওয়ার পর বাড়ি বাড়ি গিয়ে মনোনয়নপ্রত্যাশী সবার সঙ্গে দেখা করেছি। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

আসনটিতে আইনজীবী আবদুল বাতেনকে প্রার্থী করেছে জামায়াত। এ ছাড়া এনসিপির জেলার সংগঠক এ বি এম কবির আলম, ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মাওলানা আবদুল কাইয়ুম ফারুকী, সিপিবির উপজেলা সাধারণ সম্পাদক শাহিন খান ও গণসংহতি আন্দোলনের নাহিদা সাহান মাঠে আছেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ (বাঞ্ছারামপুর)

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি এই আসনে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন। এখানে কাউকে প্রার্থী ঘোষণা করেনি বিএনপি। জোট হলে আসনটি সাকিকে ছেড়ে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে বিএনপি সূত্রে জানা গেছে।

গুঞ্জন থাকায় স্থানীয় বিএনপিতে কিছু অসন্তোষ আছে। এখানে মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য এম এ খালেক, উপজেলা বিএনপির সভাপতি মেহেদী হাসান, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রফিক সিকদার ও জিয়াউদ্দিন, জেলা বিএনপির উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর সাইদুর রহমান উল্লেখযোগ্য।

এম এ খালেক বলেন, ‘জোট থেকে প্রার্থী দিলে কতটুকু সাফল্য পাবে, জানি না। দল এমন সিদ্ধান্ত নিলে মেনে নিতে হবে।’

এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে দেওয়ান নকিবুল হুদা, ইসলামী আন্দোলনের উপজেলার সহসভাপতি মোহাম্মদ আলী, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মাওলানা আবদুল মজিদ, সিপিবির জেলার সাবেক সভাপতি সৈয়দ মো. জামাল ও এনসিপির উপজেলার প্রধান সমন্বয়ক মো. মাইন উদ্দিন প্রার্থী হবেন বলে আলোচনা আছে।