‘আমি ভুইলা গেছি তাগো কথা, তারা আমার কাছে মৃত’

একেক জন এসেছেন একেক জায়গা থেকে। তবে সবার গল্পটা একই। বৃদ্ধাশ্রমে এসে হয়ে উঠেছেন একে অপরের সুহৃদ। গতকাল রোববার ফরিদপুর শহরের শান্তি নিবাসে (বৃদ্ধাশ্রম)ছবি: প্রথম আলো

বছর ঘুরে ঈদ আসে, ঈদের উৎসব শেষও হয়। পূজা আসে পূজা যায়। কিন্তু এমন বিশেষ দিনেও স্বজনদের দেখা পান না ফরিদপুরের শান্তি নিবাসের (বৃদ্ধাশ্রম) বাসিন্দারা। ফলে নিঃসঙ্গ অবস্থায় ঈদ পালন করেন তাঁরা। শান্তি নিবাসের চার দেয়ালের মধ্যে কখনো কখনো প্রিয় সন্তান-স্বজনদের কথা ভেবে মুখ লুকিয়ে নীরবে কাঁদেন। অতীতের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার দিনগুলো স্মরণ করে বুকে পাথর চেপে ঈদ কাটিয়ে দেন।

গত শনিবার (৭ জুন) উদ্‌যাপিত হয়েছে মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্যতম বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা। এ উপলক্ষে গতকাল রোববার ফরিদপুর শহরের পূর্ব প্রান্তে টেপাখোলা লেকের পাড়ে অবস্থিত বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে জানা গেল, ঈদের দিনেও বাসিন্দাদের খোঁজখবর নিতে কারও কোনো সন্তান–স্বজন আসেননি। কারণ জানতে চাইলে বাসিন্দাদের কেউ কেউ বলছেন, ‘আমার কথা তারা ভুলে গেছে।’ ক্ষোভ প্রকাশ করে কেউ বলছেন, ‘আমার কাছে তারা মৃত।’ কেউবা কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে বলছেন, ‘আজ তো সবাই ব্যস্ত, তাই হয়তো সময় করে উঠতে পারেনি।’

নড়াইলের বাসিন্দা লতিফ শিকদারের (৬০) এক বছর ধরে আশ্রয় হয়েছে শান্তি নিবাসে। এক ছেলে ও দুই মেয়ের বাবা তিনি। স্ট্রোক করার কারণে এখন কথা বলতে পারেন না। দরজির কাজ করে সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। হঠাৎ করেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা সুস্থ হন। আবার স্ট্রোক করেন। ওই সময় থেকে তিনি কথা বলতে পারেন না। ছেলে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়, কিন্তু এরপর আর কোনো খবর নেয়নি। কিছুটা সুস্থ হয়ে প্রতিবেশীর মাধ্যমে এই শান্তি নিবাসে এসে আশ্রয় নেন।

লতিফ শিকদার বলেন, ‘অসুস্থ হইয়া পড়লে ছোয়ালডা আমারে হাসপাতালে রাইখা চইলা যায়। আর আমার খোঁজ নেয় নাই। আমি বাঁচলাম না মরলাম, সে খবরও নেয় নাই। আমিও আর তাগো কাছে ফিরা যাই নাই। আমি ভুইলা গেছি তাগো কথা। তারা আমার কাছে মৃত।’

দুজন এসেছেন দুই জায়গা থেকে। তবে হেলেনা ও ময়না বেগমের গল্পটা একই। বৃদ্ধাশ্রমে এসে হয়ে উঠেছেন একে অপরের সুহৃদ। গতকাল রোববার ফরিদপুর শহরের শান্তি নিবাসে (বৃদ্ধাশ্রম)
ছবি: প্রথম আলো

বৃদ্ধাশ্রমের নিবাসীদের থাকা ও খাবারের কোনো সমস্যা নেই। তবে অভাব রয়েছে নিকটজনের সান্নিধ্য, প্রিয়জনের ভালোবাসা। শেষ বয়সে এসব থেকে বঞ্চিত আশ্রমের বাসিন্দারা আর স্বজদের কথা মনে করে কষ্ট পেতে চান না। চরভদ্রাসরে গাজীরটেক এলাকার মনা বেগম বলেন, ‘এক মেয়ে হওয়ার পর স্বামী মইরা গেল। ভাসুররা আমাকে বাড়ি থেকে বাইর কইরা দেয়। পরে মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি উঠি। মেয়ে বড় হলে বিয়ে দিই। তার ছেলে হয়। আমার নাতি ও নাতবউ আইসা এখানে রাইখা গেছে। আমাকে খাওয়ানোর ক্ষমতা নাকি তাগো নাই। তাদের কথা মনে রাখতে চাই না, ভুইলা যাইতে চাই।’

শান্তি নিবাসটি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালনা করে। ১৯৯৯ সালে ফরিদপুর সমাসেবা অধিদপ্তরের জায়গায় ৫০ শয্যাবিশিষ্ট এ শান্তিনিবাসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। চালু হয় ২০০১ সালে। এ নিবাসে ১৫ জন নিবাসীর মধ্যে ৫ জন পুরুষ ও ১০ জন নারী। এর মধ্যে ২ জন সনাতন এবং বাকি ১৩ জন ইসলাম ধর্মাবলম্বীর।

শান্তি নিবাস সূত্রে জানা গেছে, ঈদের দিন নিবাসীদের উন্নত মানের খাবার দেওয়া হয়েছে। সকালে ছিল খিচুড়ি, সেমাই ও ডিম। দুপুরে পোলাও, গরুর মাংস ও মিষ্টি। রাতেও দেওয়া হয়েছে পোলাও, খাসির মাংস ও কোমল পানীয়। ছিল নতুন পোশাকও।
জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক এ এস এম আলী আহসান জানান, শান্তি নিবাসে ১৫ নিবাসীর মধ্যে দুজন নারী ও একজন পুরুষ খুবই অসুস্থ। তাঁদের সুস্থ করতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের থাকা-খাওয়া, চিকিৎসাসহ সব ব্যবস্থা এখান থেকেই করা হয়। চেষ্টা করছি তাঁদের বাড়ির পরিবেশ দিতে।

ফরিদপুর শহরের পূর্ব প্রান্তে টেপাখোলা লেকের পাড়ে অবস্থিত শান্তি নিবাস
ছবি: প্রথম আলো

নিবাসের অসুস্থ বাসিন্দাদের একজন ঢাকার বকুল বেগম (৬২)। তিনি নিজ হাতে খেতে পর্যন্ত পারেন না, তাঁকে খাইয়ে দিতে হয়। কথাও তেমন বলতে পারেন না। তারপরও কথা বলার চেষ্টা করেন। বকুল বেগম জানান, বিয়ে হয়েছিল। স্বামীর আগের পক্ষের সন্তান ছিল। ওই সন্তানদের আদর যত্নও করতেন তিনি। কিন্তু সৎমায়ের কপালে যা থাকে, সেটাই ঘটেছে তাঁর জীবনে। একপর্যায়ে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন ধরে তিনি রয়েছেন এখানে। কেউ খোঁজও নেয় না তাঁর।

আরেক নিবাসী সাজ্জাদ শেখ (৭৪) ফরিদপুর শহরের একটি এলাকার বাসিন্দা। তিনি আট বছর দুই মাস ধরে এখানে আছেন। সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। পড়ে চাকরি ছেড়ে গাড়ি চালাতেন। চার মেয়ে ও এক ছেলের বাবা তিনি। স্ত্রী, সন্তানেরা সবকিছু লিখে নিয়ে তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন।

সাজ্জাদ শেখ কোনোভাবেই তাঁর ছেলের নাম বলতে রাজি হননি। বলেন, ‘তার নাম মুখে আনতে চাই না। সে দেশের মন্ত্রী হলেও তার কাছে যাওয়া তো পরের কথা, তার মুখও আমি দেখতে চাই না।’

শান্তি নিবাসে ফরিদপুর শহরের কুঠিবাড়ি কমলাপুর এলাকার ময়না বেগম (৬১) রয়েছেন দীর্ঘদিন ধরে। তিনি জানান, তিনি বিয়ে করেননি। ভাইয়ের সঙ্গে থাকতেন। একপর্যায়ে ভাইয়ের স্ত্রী তাঁর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার শুরু করেন। তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। বিভিন্ন জায়গায় রাস্তাঘাটে দিন কাটে তাঁর। একসময় ঠাঁই হয় শান্তি নিবাসে। ময়না বেগম বলেন, ‘যে কটা দিন বেঁচে আছি, এখানেই কাটিয়ে দেব। সবকিছু ভুলে গিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করছি নিজের জন্য।’