মাঠের রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হলেও অপকর্মে সক্রিয় ছাত্রলীগ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ফাইল ছবি

আসন-বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, অপহরণ, শিক্ষার্থী নির্যাতন, মাদক ব্যবসা, র‍্যাগিংসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শাখা ছাত্রলীগের নেতারা। পিছিয়ে নেই ছাত্রলীগ নেত্রীরাও। ধর্ষণের হুমকি, শিক্ষার্থী নির্যাতনের অভিযোগে গণমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছেন তাঁরাও। তবে মাঠের রাজনীতিতে অনেকটাই নিষ্ক্রিয় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। দীর্ঘদিন ধরে নেই সাপ্তাহিক মিছিল। বিভিন্ন দিবসকেন্দ্রিক কর্মসূচিগুলোতে নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি খুবই নগণ্য। ক্যাম্পাস ছেড়েছেন মূল কমিটির প্রায় ৯০ শতাংশ নেতা-কর্মী। এ ছাড়া হল কমিটির শীর্ষ নেতারাও রাজশাহী ছেড়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ছাত্রলীগের চারজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলছেন, দীর্ঘদিন কমিটি না হওয়ায় অধিকাংশ নেতা-কর্মী রাজনীতি থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। তবে ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে গুটিকয় ছাত্র বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে সংগঠনের সুনাম নষ্ট করছেন। এ অবস্থায় দ্রুত সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ১৩টি অভিযোগ জমা পড়ে। অধিকাংশ অভিযোগের সত্যতা পেলেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো প্রশাসনের মাধ্যমে ভুক্তভোগীর সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করেছে।

যত অভিযোগ

গত বছরের জুলাই মাসে রাবির ভর্তি পরীক্ষা চলাকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী অপহরণ করে চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠে বঙ্গবন্ধু হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জেমস, জিয়া হলের সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম, আইবিএ ইনস্টিটিউটের সাধারণ সম্পাদক অমিত সাহা ও ছাত্রলীগ কর্মী তামিমের বিরুদ্ধে। গত বছরের ১১ আগস্ট জিয়া হল ছাত্রলীগ সভাপতি রাশেদ খান ও হবিবুর রহমান ছাত্রলীগের সহসভাপতি সোহাগের বিরুদ্ধে এক দোকানির ক্যাশবক্স থেকে ৫০ হাজার টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগ ওঠে। সপ্তাহ না যেতেই ১৭ আগস্ট শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সুরঞ্জিত প্রসাদ বৃত্ত ও মতিহার হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ভাস্কর সাহার বিরুদ্ধে তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের এক শিক্ষার্থীকে তুলে নিয়ে নির্যাতন ও তাঁর কাছ থেকে ৪৫ হাজার টাকা কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে।

এই ঘটনার দুই দিন পর মতিহার হলে চাঁদার জন্য এক শিক্ষার্থীকে আটকে রেখে তিন ঘণ্টা নির্যাতন করে ভাস্কর সাহা। এ ঘটনার সত্যতা পায় তদন্ত কমিটি। গত ৮ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের চার নেতাকে ৩২০ গ্রাম গাঁজাসহ আটক করেন প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা। পরে জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা স্বীকার করেন বিক্রির উদ্দেশ্যে তাঁরা এই গাঁজা এনেছেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে প্রথম বর্ষের এক হিন্দু শিক্ষার্থীকে মারধর ও ‘শিবির’ বলে হত্যার হুমকি দেন হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাইম ইসলাম ও যুগ্ম সম্পাদক সোলাইমান। ২৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগের তিন নেতার বিরুদ্ধে এক ছাত্রীকে হত্যার হুমকি ও তাঁর বন্ধুদের মারধরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ২০৮ ফেব্রুয়ারি মন্নুজান হল ছাত্রলীগের সহসভাপতি আতিফা হক ওরফে শেফার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তিনি এক ছাত্রীকে বন্ধুদের দিয়ে ধর্ষণের হুমকি দিয়েছেন।

সর্বশেষ ১৭ মার্চ ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে না যাওয়ায় সমাজকর্ম বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সাফায়েত হোসেনকে মারধর করার অভিযোগ ওঠে মতিহার হল ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হাসান ও ছাত্রলীগ কর্মী আল-আমীনের বিরুদ্ধে। ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে আবাসিক হলের সিট-বাণিজ্যের অভিযোগের বিষয়টি অনেকটাই ওপেন সিক্রেট হয়ে গেছে।

তবে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ মানতে নারাজ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া। তিনি বলেন, সব ঘটনায় ছাত্রলীগ জড়িত এমনটা নয়। দু-একটি ছোট ঘটনাকে মিডিয়াগুলো বড় করে প্রচার করে। তবে ছাত্রলীগ একটি বড় ছাত্রসংগঠন, অনেকের ছোটখাটো ভুলভ্রান্তি হতে পারে। তাঁরা অভিযোগ পাওয়ার পরপরই অভিযুক্তদের সতর্ক করার চেষ্টা করেন।

মাঠের রাজনীতিতে অধিকাংশ নেতা নিষ্ক্রিয়

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ ও ১৭টি আবাসিক হল মিলিয়ে অন্তত ৭০০ পদধারী নেতা আছেন। সেই তুলনায় কেন্দ্রঘোষিত ও দিবসকেন্দ্রিক কর্মসূচিগুলো নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি খুবই নগণ্য। গত ডিসেম্বর থেকে চলতি মাস পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, কর্মসূচিগুলোতে সর্বোচ্চ দুই থেকে আড়াই শ নেতা-কর্মী অংশ নেন। এর মধ্যে অন্তত ৫০ জন কর্মী থাকেন সেখানে।

পদধারী নিষ্ক্রিয় চার নেতা বলেছেন, একজন শিক্ষার্থীর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করতে সময় লাগে ৫ বছর। তারপর আর ওই শিক্ষার্থীর ছাত্রত্ব থাকে না। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটি সাত বছর ধরে চলছে। এখানে অনেকে শাখা ছাত্রলীগের শীর্ষ পদের আশায় রাজনীতি করেন। কিন্তু দীর্ঘদিন কমিটি না হওয়ায় তাঁরা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন।

ক্যাম্পাস ছেড়েছেন হলের শীর্ষ নেতারা

দীর্ঘ সাত বছর পর গত বছর মার্চে সম্মেলনের মাধ্যমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭টি আবাসিক হলে ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়। তবে বছর না যেতেই হল ছেড়েছেন একাধিক ছাত্রলীগ নেতা। অনেকেই ক্যাম্পাসে নিয়মিত থাকেন না। তাঁদের মধ্যে আছেন শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক হল ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান, মতিহার হলের সভাপতি রাজীব, সৈয়দ আমীর আলী হলের সভাপতি মো. সিয়াম ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মারুফ, মাদার বখ্শ হল সভাপতি শারাফাত হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক রাথিক, শহীদ হবিবুর রহমান হল ছাত্রলীগ সভাপতি মো. মমিন।

বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ বলেন, ক্যাম্পাসে দীর্ঘদিন কমিটি হয়নি। এর মধ্যে নেতা-কর্মীদের অনেকের পড়াশোনা শেষ হওয়ায় ক্যাম্পাস ছেড়েছেন। দীর্ঘদিন কমিটি না হওয়ায় অনেক নেতা-কর্মীর মধ্যে অসন্তুষ্টি আছে। তাই দ্রুত নতুন কমিটি ঘোষণা হলে ক্যাম্পাসের রাজনীতিতে সক্রিয়তা বেড়ে যাবে।

সার্বিক বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কমিটির মেয়াদ অনেক দিন হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতারাও আমাদের কাছে কমিটির জন্য বলেছেন। আমরা দ্রুত একটি স্মার্ট কমিটি দেওয়ার চেষ্টা করব। আশা করছি, এতে সমস্যা অনেকটা কেটে যাবে।’